DEHLIJ

তামিমৌ ত্রমি

উদ্ভ্রাণ্ডুর তিন মিনিট




যদিও আমরা এতদিনে জেনে গেছি উদ্ভ্রাণ্ডুর দু’চারটে বৈশিষ্ট্য তবু আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক।


প্রথমতঃ উদ্ভাণ্ডুর পেট খসানো মা তাকে ডাস্টবিনে নিঝুম রাতে ফেলে গেছিল। কুত্তারা হয়ত তাকে ছিঁড়েই খেয়ে ফেলত কিন্তু একটা মাসিকের প্যাড তার নাকে সুড়সুড়ি দেওয়ায় সে ‘ওঁয়া ওঁয়া’ করে কেঁদে ওঠে। একজন মাতাল ভিখিরি তার কান্নার আওয়াজ শুনে টলতে টলতে ডাস্টবিন থেকে তাকে উদ্ধার করে। 


দ্বিতীয়তঃ ওই ভিখিরি দাদু উদ্ভ্রাণ্ডুকে কোলে শুইয়ে দু পয়সা বেশী রোজগার করতে থাকে, উদ্ভ্রাণ্ডু ‘ওঁয়া ওঁয়া’ থেকে ‘আহ আহ’ করে হাওড়া-শেয়ালদা হাওড়া-শেয়ালদা করার মতো  ‘লায়েক’ যখন হয়ে গেল, সেইরকম একটা সময়ে এক রাতে মদ খেতে খেতে তার  মাতাল ভিখিরি দাদু  রক্তবমি করে মারা যায়।


তৃতীয়তঃ তার অ্যানোসমিয়া আছে। সে গন্ধ পায় না। সে সম্পর্কে তার অস্পষ্ট ধারণা আছে কিন্তু স্পষ্ট ধারণা নেই। প্রকৃতপক্ষে তার কোনকিছু নিয়েই কোন স্পষ্ট ধারণা নেই কারণ সে মূলত একজন বিশুদ্ধ ‘উদ্ভ্রাণ্ডু’


উদ্ভ্রাণ্ডু ‘দেখে’ আর ডাস্টবিন থেকে খাবার খুঁটে খায়। তার মতো আরও মানুষরা খায়, কুত্তা খায়, বিল্লি খায়, ইঁদুর খায়, ছুঁচো খায়, কিন্তু আমরা এই গল্পে শুধু উদ্ভ্রাণ্ডুকে নিয়েই কথা বলছি এবং উদ্ভ্রাণ্ডু শুধু খায় না, দেখেও। 


সেদিন দুপুর বেলা দত্তদের বাড়ির মিনির একবাটি বেড়ালে মুখ দেওয়া মাংসের ঝোল ভাত খেয়ে উদ্ভ্রাণ্ডু আয়েস করে শুয়ে পড়েছিল ওর আস্তানায়; মানে ভ্যাটের পাশে। ঢিল ছোঁড়া দুরত্বেই কুকুরে খানিকটা হেগে রেখে গেছে। চব্বিশ হাত দূর দিয়ে হাঁটলেও গা গুলিয়ে ওঠার কথা কিন্তু উদ্ভ্রাণ্ডুর আনোসমিয়া তাকে নাসারন্ধ্র সম্বন্ধীয় যাবতীয় জ্বালা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছে। 


তা কথা হচ্ছিল সেদিনের। মাংস পেটে পড়ায় একটু রাজামন রাজামন লাগছিল উদ্ভ্রাণ্ডুর। রোদের তেজটাও কম। এই ভরদুপুরে হাওয়াবাতাসও হালকা করে যখন তখন পাদছে। উদ্ভ্রাণ্ডুর চোখদুটো ফেভিকল কা মজবুত জোড়ে সেঁটেই গেছিল প্রায়, এমন সময় ‘বোঁওওওও …’ 


উদ্ভ্রাণ্ডু তার ঘুমচোখ দুটো কোনমতে চিরে দেখল, আকাশ চিরে একটা প্লেন যাচ্ছে। সে ভাবল বুঝি স্বপ্নই দেখছে। কিন্তু স্বপ্নের নীল ছলছলে যখন মুত মিশতে থাকে তখন মানুষের বাস্তববোধ মাথা তোলে। উদ্ভ্রাণ্ডু বুঝল, মুতের বেগটা যেমন সত্যি; তেমন ওই দুপুরের ঝলমলে আকাশটা সত্যি; তেমন ঐ প্লেনটাও সত্যি। 


কিন্তু ওগুলোও কী সত্যি!


ওগুলো কী প্লেনের গায়ে! কিলবিলে ছারপোকা। ছারপোকা এত বড় হয়! তাছাড়া পোকার মতো তো নয় ওগুলো। কেমন যেন বাদুড় বা চামচিকের মতো। প্লেনের গায়ে গায়ে ঝুলে আছে। লাল বাদুড়, নীল বাদুড়, সবুজ বাদুড়, হলুদ বাদুড়…


উদ্ভ্রাণ্ডু হতবাক। এমন কাণ্ড সে সারাজীবনে দেখেনি। মস্তবড় প্লেনটার আগাপাশতলায় সেঁটে আছে রঙীন বাদুড়েরা। তাদের রঙ্গীন ডানাগুলো পতপত করে উড়ছে। 


আর মজার কথাটা হচ্ছে, প্লেনটা ঠিক উদ্ভ্রাণ্ডুর মাথার আকাশের উপরই থেমে গেল। পরক্ষণেই একটা নীল রঙের বাদুড় প্লেনের গা থেকে চলকে তার নীলাভ ডানা মেলে দিল। আহা, নীল আকাশে নীল ডানার পাখি। যেন জলজ্যান্ত স্বপ্নই দেখছে উদ্ভ্রাণ্ডু। একটা কাটা ঘুঁড়ি - নীলিমার  মতো হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে টুপ করে খসে পড়ল মসৃণ নীলাভ বাদুড়। আর এই মাটিতেই। একেবারেই তার দু হাত দূরত্বে সেই নীল রঙের বাদুড় এসে ‘দাঁড়াল’!


উদ্ভ্রাণ্ডুর মনে হল কেউ যেন কেউটেপাক দিয়ে বেঁধেছে তাকে। বা কালিপুজোর রাতে তুবড়ির প্রচণ্ড আগুন -বৃষ্টির পর একটা জ্বলন্ত শান্তি তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এ তো বাদুড় নয়! এ তো মানুষ! একটা মেয়ে। মাথা ঢাকা। গা ঢাকা। শুধু মুখটুকু দেখা যাচ্ছে। আর হাতের পাতা। ওই তিনটে অঙ্গ যেন এই ভরদুপুরের আকাশ -ছাঁচা গনগনে।


এ তো দাশগুপ্তদের বাড়ির ডবকা লালির চেয়েও হাজার হাজার গুণে সুন্দরী। তবু এই অপ্সরাকে দেখেও উদ্ভ্রাণ্ডুর বাঁড়া উঠল না। লালিকে দেখেও আজকাল ওঠে না। এখন, গল্পটা যেহেতু উদ্ভ্রাণ্ডুকে নিয়ে, তাই আপাতত উদ্ভ্রাণ্ডু আর সেই নীল পরীকে মুখোমুখি দু হাত দূরত্বে রেখে উদ্ভ্রাণ্ডুর বাঁড়া না ওঠার গল্পটা বলা যাক। 


উদ্ভ্রাণ্ডু একদিন ওপাড়ায় গিয়েছিল। সে এপাড়া, ওপাড়া, বেপাড়া সব জায়গাতেই ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। কেউ তাকে কিছু বলে না, বরং কেউ কেউ তাকে ভালোওবাসে। কারণ এতদিনে সবাই জেনে গেছে যে ও একটা উদ্ভ্রাণ্ডু। ওকে দিয়ে কিছুই হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, ওকে দিয়ে কারোর কোন ক্ষতি হবে না।


তা সেদিন ওপাড়ায় গিয়েছিল সন্ধ্যের দিকে। লালুমিয়া দিশি গিলে টর হয়ে হেলে পরেছিল  একটা রিকশার ডান্ দিকের টানাটায়। শালা জাতে মাতাল হলে কী হবে, তালে ঠিক। উদ্ভ্রাণ্ডু আসতেই তাকে রক্তচোখে টেনে টেনে চার অক্ষরের বোকা পেড়ে বলল, ‘ আয়, আমার পাশে বসে পড়। অনেকদিন পরে ভালো খ্যাটন হবে। মাংসটা এখন সবে কষাচ্ছে। এরপরে খাওয়াদাওয়া হবে। তখন তো এঁটোকাঁটাগুলো ফেলতে আসবে। এই বাড়ির জেনানাদের আবার মায়াদয়ার মন, তারা লালুমিয়ার জন্য দয়া করে একটা দুটো খানিকটা মাংস লাগা হাড় ঠিক ফেলে যাবে এঁটোকাঁটার সঙ্গে। বহুত দিনের ভিখিরি তো -এই ছিটেফোঁটা দয়াগুলো লালুমিয়া পায়। যেমন উদ্ভ্রাণ্ডু দয়া পায় দাশগুপ্ত আর দত্ত বাড়ির থেকে। লালুমিয়ার লালাভ কুত্তা জিভে জল এসে গেল। উহ! যা গন্ধ বেরিয়েছে খোদা না নেমে আসে আকাশ থেকে… বলাই বাহুল্য আকাশ থেকে খোদা নামানোর গন্ধ পাবার উপায় উদ্ভ্রাণ্ডুর নেই কিন্তু জিভ তো আছে। মাংসের কথা শুনে তার জিভটা সুলুক সুলুক করে উঠল। 


তা সুলুক সুলুক জিভ নিয়ে বেশ তো সময় চাটছিল তারা। হঠাৎ পাশের গলি থেকে কতগুলো  ষণ্ডাপাণ্ডা লোক, হাতে তলোয়ার, মুখে কাপড় বাঁধা… এসেই দড়াম দড়াম করে লাথি কষাতে লাগল সেই দরজায় যে দরজায় একটু আগে খোদা নেমে আসার কথা ছিল লালুমিয়ার মতে।


ঐ তো শ্যাওলা ধরা আদ্যিকালের কাঠের দরজা।  কয়েকটা লাথি কষাতেই দরজাটা হাট করে খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েমদ্দ সকলের প্রাণফাটা চিল চীৎকার। দরজা বন্ধ হয়ে গেল তাদের মুখের উপর সেই একই লাথির প্রক্রিয়ায়। এই চিৎকারেও খোদা নেমে আসতে পারতেন কিন্তু এলেন না। তলোয়ারের ঘচাং ঘচাং, মা মাসি শোয়ানো গালাগাল, কলিজা ফেটে যাওয়া আর্তনাদ, মেয়েছেলেদের কান্না… সবকিছু ছাপিয়ে জ্বলে উঠল আগুন। লালুমিয়া আর উদ্ভ্রাণ্ডু শ্বাস প্রশ্বাস নিতে নিতে বা না নিতে নিতে গলা উঁচু করে দেখল আগুনের অনেকগুলো জিভ, তাদের চেয়েও লকলকে; খিদেয় কাতর… বাড়ির চালের উপর থেকে ঝলসাচ্ছে। সে কী গিলছে সে বোঝবার উপায় নেই কিন্তু কিছু একটা সুস্বাদু গিলছে, তার ধোঁয়ায় কেমন কাবাব কাবাব পয়েগাম। 


আগুনে উঠোনটাকে নিকিয়ে দিয়ে সেই মুখে রুমাল বাঁধা, হাতে রক্তমাখা তলোয়ারেরা  আরেকবার ঝনঝন শব্দে দরজা খুলে পাশের গলিতে মিলিয়ে যাওয়ার আগে… একবার চোখ ওগরাল লালুমিয়া আর উদ্ভ্রাণ্ডুর দিকে… কিন্তু তাদের মতো পথের ফালতু কুত্তাদের দিকে চোখ বুলিয়েই তাদের কেউটেদৃষ্টি নির্বিষ হয়ে এল। 


তারা ছায়া হয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যেতেই উদ্ভ্রাণ্ডু আর লালুমিয়া সটান তাকাল বাড়ির ভিতর। দেখল,ঐ বাড়ির উঠোনের মাঝখানে খুঁটিতে বেঁধে রাখা ঘরের-মালিক পুড়ে পুড়ে কাবাব হচ্ছে। রাস্তায় আর কেউ নেই। শালাদের তলোয়ারের ঝনঝনানির আওয়াজ পেয়েই ইঁদুরের মতো সব যে যেখানে পেরেছে গর্তে সেঁধিয়েছে। 


উদ্ভ্রাণ্ডু আর লালুমিয়া বাড়ির ভিতর পা রাখল।


মালিকের বিবিটা মাটিতে আছড়ে পড়ে কাঁদছে। বুড়ি মা’টা চীৎকার করে কপাল ঠুকছে। ছেলেটা হাঁটু মুড়ে বুক চাপড়ে কাঁদছে। রান্নাঘরের সামনের দাওয়ায় উলটে রয়েছে এক কড়া মাংস আর  দাওয়া  থেকে উঠোনে গড়িয়ে পড়ছে  লাল লাল মাংসের ঝোলের ধারা। এই সেই মাংস , যার ছিবড়ে টুকু পাওয়ার জন্য তারা মুখিয়ে ছিল এতক্ষণ। ঘেয়োকুত্তাটা সুড়ুত সুড়ুত করে ঝোল চাটতে লেগেছে। প্রথমে আগুন দেখে হারামিটা ভয় গিয়েছিল। তারপর উদ্ভ্রাণ্ডু আর লালুমিয়া ঢুকতেই সাহস পেয়ে তাদের পিছন পিছন লেজ নাড়তে নাড়তে ঢুকে পড়েছে। আর এখন লকলকিয়ে চেটে নিচ্ছে মাংসের ঝোল যেমন আগুন চেটেপুটে সাবাড় করে দিচ্ছে এই বাড়ির মরদটাকে। উদ্ভ্রাণ্ডু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল , যেমন দেখে। সে এতদিন ভাবত কোন কিছু পুড়লেই শুকিয়ে আমসি হয়ে কুঁকড়ে ছোট্ট হয়ে যায়। কিন্তু না, পুড়লে আগে মাংস থেকে চোখের জলের মতো টপটপ, না কলের জলের মতো তোড়ে জল বেরোতে থাকে। এত জল! এত জল থাকে মানুষের শরীরে! আজব তো! এত জল যে সেই জল ডাইনী আগুনের তাপে শুকিয়ে যেতে যেতেও তাদের পা ধুয়ে চলে গেল রক্তের মতো মাংসের ঝোলের দিকে …মিশে গেল খাদ্য খাদকের ঝোল -গরম মশলা। আর একটা ঘেয়োকুত্তাটা জিভ দিয়ে চেটে নিতে লাগল সেই কালান্তক ঝোল।



 জল পুরোপুরি মরে আসবার আগে অবশ্য আস্তে আস্তে ইঁদুররা যে যার গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে উঠোনে ভীড় জমাতে শুরু করেছিল। তবু, ঐ অত ভীড়, হল্লা, কান্না, চেঁচামেচির মধ্যেও উদ্ভ্রাণ্ডু  দেখল, লোকটার অতবড় দশাসই দেহটা পুড়ে পুড়ে  শুকিয়ে ছোট্ট হয়ে যেতে লাগল  আর সেই শুকিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে উদ্ভ্রাণ্ডুর বাঁড়াটাও যে শুকিয়ে ছোট্ট হয়ে গেল, তা তখন বোঝেনি সে।  পরে বুঝেছে। আস্তে ধীরে বুঝেছে। যখন একটু আধটু বুক দেখানো টপ আর হাফ প্যান্ট পরে লালি বন্ধুদের সঙ্গে রবিবার বিকেলে ফুচকা খেতে গেল, তার বাঁড়াটা কিন্তু আগের মতো শক্ত হল না, সেই প্রথম সে বুঝল, কিছু একটা ঘটে গেছে তার। তারপর রাত্তির বেলা ঠেলাপল্টু যখন মোবাইলে ন্যাংটো মেয়েদের ভিডিও দেখতে দেখতে ঠেলাতেই শুয়ে পড়ে নাড়াচাড়া করতে করতে কল খুলে জল বার করে ফেলল অথচ তার হাজারবার হাওড়া-শেয়ালদা করা সত্ত্বেও ধন লতার মতো নেতিয়ে রইল, তখন ঠেলাপল্টু একবার তার কেঁচো আর একবার তার মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে বলেছিল, ‘তুই কী ধজো হয়ে গেলি বে উদ্ভ্রাণ্ডু!’


সুতরাং, আমাদের গল্পের নিহেড়ে নায়ক উদ্ভ্রান্ডু এখন ধজো। সেইজন্য মাত্র দু হাত দূরত্বে ওরকম নরম গোলাপি আর সোনা মেশানো পরী কিংবা পুতুলের মতো মেয়ে দেখেও তার বাঁড়া ওঠে না। বরং ঘটনার আকস্মিকতায় আরও কুঁকড়ে যায়। তারপর ঝুলে সহজ হয়ে যায়। মেয়েটার চোখে কি যেন আছে। কী মায়া! যেন চোখ দিয়েই উদ্ভ্রাণ্ডুর চুলকে ঘা করা হাঁটুতে মলম লাগিয়ে দিতে পারে। উদ্ভ্রাণ্ডুর কেমন যেন বোন বোন মনে হতে থাকে মেয়েটাকে । চোখ অমন মায়াবী বোন বোন হয় বুঝি ! তার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, ‘বোনটি রে, তুই এই আস্তাকুঁড়ে নামলি কেন? এখানেই,এখানেই নামতে হল তোকে?’


কিন্তু সে কিছু বলার আগেই মেয়েটা একটা অজানা ভাষায় কিসব বলে ওঠে তাকে। এক মুহুর্ত সে হাবার মতো চেয়ে থাকে মেয়েটার দিকে। তারপরই সে যন্তরটা নিয়ে আসবার জন্য ছোটে। অনেক দিন আগে এক দুপ্পুরবেলায় জোষ্ঠি মাসের কাঠফাটা গরমে এক টাকমাথা গোল্লা গোল্লা চশমা পড়া দাড়িমুখো পাগল, গায়ে নোংরা জামা, এই যন্তরটা আবর্জনায় এসে ফেলে দিয়ে গেছে। খুব তাড়া ছিল পাগলটার। খুব। আর ওরই মধ্যে কীসব হাবিজাবি বকে চলেছিল লোক টা। সেই পাগলটা  নাকি গিরিডি বলে একটা জায়গা, যেখানে উশ্রী না বিশ্রী নামে ঝরণা আছে, সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে এতদূর এসেছে। তার নাকি এনিহিল নামে একটা বন্দুক ছিল, যেটা থেকে গুলি ছুঁড়লেই মানুষ রাতারাতি গায়েব হয়ে যায়। সেটা সে টুকরো টুকরো করে লাল পিঁপড়েদের দিয়ে খাইয়েছে। তার নাকি একটা ওষুধ ছিল, যা খেলে সব রোগ ভাল হয়ে যায়- সেই ওষুধগুলো সে উশ্রী ঝরণায় ঢেলে দিয়েই পথে বেরিয়েছে। আর কোনদিন কোনকিছুই সে বানাবে না। মানুষের মতো হারামিদের জন্য সে আর কখনো কিচ্ছু বানাবে না এই জীবনে… বলে থু থু থু করে সে কি গয়ের ফেলার ধূম। কিছুক্ষণ হাঁপিয়ে হাপরের মতো বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে কেশে গলা পরিস্কার করে তার নোংরা ঝোলাটা থেকে যন্তরটা বের করে পাগলটা  বলেছিল, ‘ এই যন্ত্রটা রাখ। এই যে সুইচটা দেখছিস, এটা টিপলেই তুই মানুষ, কুকুর, বিড়াল, ছারপোকা, গাছপালা, সকলের ভাষা বুঝতে পারবি।’ 


উদ্ভ্রাণ্ডুর হেব্বি মজা লেগেছিল; ভাবল আচ্ছা পাগল তো। পাগল তো উদ্ভ্রাণ্ডু সারাজীবন দেখেছে। এই ভ্যাটের একপাশে যেমন ওর আস্তানা, আরেক পাশে বিশু পাগলের। নন্দিনী বলে কোন একটা মেয়ের কাছে লাথ খেয়ে মাথাটাই বিগড়ে গেল। তারপর থেকে সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে আর থেকে থেকে  ‘নন্দিনীইইই…’ বলে আকাশ বাতাস ফাটিয়ে চেঁচায় আর রাত্তির বেলা শুয়ে শুয়ে ঘুমের ঘোরে কাঁদে। আরেকটা আছে কানবোজা পাগল। সারাদিন যত কাগজ কুড়িয়ে পায়, কানে গোঁজে। কিছু নকল পাগল আছে, যারা চোর চোট্টা, পকেটমার , ভিখিরি… কিন্তু এই লোকটা একেবারেই তা নয়। এক্কেবারে অন্য কিসিমের পাগল, বলে কিনা এই খেলনাটা দিয়ে সক্কলের ভাষা বোঝা যায়। আজব পাগল মাইরি। 


মজা পেতে পেতেও একটু সমীহ হল পাগলটার প্রতি। সে পাগলটার চোখে চোখ রাখল। এমন পাগল সে দেখেনি আগে। চোখে পাগলামির চিহ্নমাত্র নেই। উদ্ভ্রাণ্ডু পাগলটার ব্যক্তিত্বে মোহিত হয়ে গেল। এক মুহুর্তের জন্য তার মনে হল, এই পাগলটা পাগল হতেই পারে না। অসম্ভব। সে ভূতগ্রস্তের মতো বলে উঠল, ‘আচ্ছা, এই ‘যন্তর’টা তুমি আমায় দিচ্ছ কেন? 


পাগলটা মুচকি হাসল। তারপর তার হাতে যন্তরটা দিয়ে উদ্ভ্রাণ্ডুর মাথায় সস্নেহে আঙুল চালিয়ে বলল, ‘তুই উদ্ভ্রাণ্ডু বলে’ বলেই আর একবারও পিছন না ফিরে গট গট করে হেঁটে ভীড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। 


পাগলটা চলে যাবার পরেও পাগলটা থেকে গেল উদ্ভ্রাণ্ডুর মনের মধ্যে বা পাগলটা হয়তো উদ্ভ্রাণ্ডুকে নিয়ে গেল তার মনের ঝোলায়। ঘটনাটা যা-ই হোক, কিই যে মনে হল তার সেই রাতে, গভীর রাতের নিঃসাড় পৃথিবীতে যখন মানুষ বলতে একমাত্র বিশু পাগলের কান্নার আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না, তখন সে যন্তরের সুইচটা অন করল…আর সঙ্গে সঙ্গে সে শুনতে পেল মোটাসরুমিহিগাঢ়ফিসফিস নানা গলার চালেডালে শব্দখিচুড়ি! কুকুর, বেড়াল, ছুঁচো, ইঁদুর, সরসরা পিঁপড়ে, লাল পিঁপড়ে, কেঁচো, কেন্নো, গুবরে, ঝিঁঝিঁ, এই পৃথিবীতে সবারই বক্তব্য আছে, এত এত কথা আছে সকলের মনে! বুকটা ধক ধক করতে লাগল তার!তার মানে পাগলটা পাগল ছিল না… বা বদ্ধ পাগল ছিল! নইলে এমন যন্তর বানিয়ে কেউ উদ্ভ্রাণ্ডুর মতো পথের কুত্তার কাছে ফেলে রেখে যায়! প্রতি রাতে খুটুর খাটুর করে সে বুঝে গেল, যন্তরটা কীভাবে চালাতে হয়, এত অজস্র কথাদের মধ্যে থেকে কি করে নির্দিষ্ট একজনের সঙ্গে কথা বলতে হয়। এমন কিছু শক্ত নয় ব্যাপারটা। এমন সাংঘাতিক একটা যন্ত্র অথচ কত সহজভাবে চালানো যায়। ভ্যাটের পিছন দিকের একটা গুপ্ত জায়গায় উদ্ভ্রাণ্ডু দিনের বেলা যন্তরটা লুকিয়ে রাখে। আর রাত্তির বেলায় ‘কথা বলে আর কথা শোনে’… যেই ঘুমের প্রথম হাইটা ওঠে অমনি সে যন্তরটাকে আবার গুপ্ত স্থানে রেখে এসে ঘুমিয়ে পড়ে।  



উদ্ভ্রাণ্ডু তাড়াতাড়ি সেই যন্তরটা গুপ্ত স্থান থেকে বের করে নিয়ে এসে তার আনকোরা প্যাকেটে মোড়া সোনা সোনা বোনটির দু হাত দূরত্বে এসে দাঁড়াল। তারপর সুইচ অন করে ওকে বলতে বলার ইঙ্গিত করল উদ্ভ্রাণ্ডু। যাক। ইঙ্গিতটা বুঝল মেয়েটা। তার পাতলা মোমের মতো গোলাপি ঠোঁট দুটো নড়তে আরম্ভ করল। 


‘ভাইজান, আমি পশ্চিমের মেয়ে। আমাদের দেশে আবার ডাইনোসররা হানা দিয়েছে। ওরা আবার আমাদের এক এক হাঁয়ে গিলে ফেলবে। রক্তের বন্যা বওয়াবে। সেইজন্য আমরা আমাদের দেশ (এই শব্দটা বলার সময় টপ টপ করে মেয়েটার গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল) ছেড়ে মাটি ছেড়ে  প্রিয় দেবদারু গাছেদের সারি ,নীল পাহাড়, তাদের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া রাস্তা ছেড়ে, ভাই বোন ছেড়ে, মা বাবা ফেলে, যে যার মতো যেদিকে পারছি দুদ্দাড় করে পালাচ্ছি। কিন্তু প্লেন তো এইটুকুনি আর ক’ টাই বা সংখ্যায়। তাই যারা প্লেনে জায়গা জোটাতে পারিনি, তারা কোনমতে বাদুরের মতো প্লেনে ঝুলে ঝুলে আকাশ পেরোচ্ছি। কিন্তু আমার বড় পায়খানা পেয়েছে ভাইজান। সেই যে পিছন পিছন একটা টিরেনসরাস তার দৈত্যের মতো বড় বড় থাবা ফেলে এগিয়ে আসছিল আমাদের দিকে, আমার বাবাকে বুড়ো আঙ্গুলের নখের ডগায় তুলে হাঁয়ের মধ্যে ফেলে দিল আর চোদ্দ বছরের ভাইটাকে পিঁপড়ের মতো পায়ে পিষে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে এগিয়ে আসছিল, সেই দেখে আমি আর পিছন ফিরে তাকাইনি (চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল; মুখটা কয়লার মতো কালো।) সামনে যে প্লেনটা পেয়েছি তাতে বাদুড় হয়ে ঝুলে পড়েছি। দাঁত মাজা, চান পায়খানা কিছুই সারা হয়নি। প্লেনে যদি ঢুকতে পারতাম তাহলে তো সেখানকার বাথরুমেই পেচ্ছাপ – পায়খানা সেরে নিতাম কিন্তু ঢুকতেই তো পারলাম না ভাইজান, অথচ বড় জোরে পেয়েছে। পাইলট তিন মিনিট সময় দিয়েছে ভাইজান, এর মধ্যেই যা করার করতে হবে, নইলে যে কাপড়েচোপড়ে হয়ে যাব। 



উদ্ভ্রাণ্ডু যেহেতু উদ্ভ্রাণ্ডু, তাই সে পশ্চিম, ডাইনোসর, টিরেনোসরাস, দেশ, মাটি, দৈত্যের থাবা… এতসব কিছুই বুঝল না। শুধু এটুকু বুঝল, বোনটির জোরে পায়খানা পেয়ে গেছে আর হাতে  মাত্র তিন মিনিট সময় আছে। সঙ্গে সঙ্গে সে ভ্যাটের পিছনদিকের একটু যে অন্ধকার  মতো জায়গাটা সেখানে  যে ময়লা শতচ্ছিন্ন দুটো চাদর পেতে সে রাতে শোয় সেই দুটো দিয়ে একটু ছাউনি মতো করে তাকে ইশারা করল। বোনটি নিশ্চিন্তে ঢুকে যেতেই সে ছাউনির পাহারাদারি করতে শুরু করল। তার মুখ রাস্তার দিকে। হ্যাণ্ডেল ভাঙা বিবর্ণ এক বালতি জল আর লালিদের বাড়ির ফেলে দেওয়া ফাটা মগটা অবশ্য সে ছাউনিতে আগেই রেখে এসেছিল।



কাজ সারবার পর ছাউনি থেকে বেরিয়ে এল মেয়েটা। উদ্ভ্রাণ্ডুর দিকে চাইল। চোখের কল খুলে গেছে বোনটির। ফুল ফোর্সে জল পড়ছে অথচ মোমের মতো নরম গোলাপি ঠোঁটে ফুলের মতো হাসি। উদ্ভ্রাণ্ডু যন্তরটা অফ করে দিল। সব ভাষা বোঝবার জন্য যন্তরের দরকার হয় না। উদ্ভ্রাণ্ডু তার আবছা চোখে বোনটিকে হাসি ফেরত দিতে না দিতেই বোনটির নীল পাখা দুলতে শুরু করেছে। তার বোনটি উড়ে যাচ্ছে। নীল আকাশের বুক চিরে উড়ে যাচ্ছে নীল পাখি পরীটি। পরী বোনটি যেন ভালো থাকে। পরী যেন নতুন একটা দেশ পায়, মাটি পায় আরও যেন কি কি পাবার, তাই পায়। আজ রাতে  উদ্ভ্রাণ্ডু ওই ছাউনিতেই শোবে। যদিও সেখানে তখনো পড়ে আছে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকা ভয়,  আতঙ্ক, উদবেগ আর বহুক্ষণ আটকে রাখার পর এক  মোচড়ে হড়হড় করে হাগা কাদা কাদা থকথকে আমাশার  মতো পায়খানা। এতক্ষণে তার উপর ভনভন করতে লেগে গেছে গুয়ে মাছির দল। তবু… ওইটুকুই তো বোনটির স্মৃতি । আরেকটা গুয়ে মাছি হয়ে ওরই এক কোণে উদ্ভ্রাণ্ডু জায়গা করে নেবে।


এই প্রথম উদ্ভ্রাণ্ডুর স্পষ্ট ধারণা হল যে সে নাকে গন্ধ পায় না। এবং তার প্রচণ্ড দুঃখ হল। নইলে বোনটির হাগার সোহাগা গন্ধটুকু তো সে বসে বসে পেতে পারতো এতক্ষণে। 


No comments