DEHLIJ

শোভনলাল আধারকার

 খেয়ালী



এই নতুন পাড়ায় আসার পর থেকেই বাড়ির সামান্য দূরে ছোট ত্রিভুজাকৃতি “শ্রীলঙ্কা পার্ক”এ কয়েকজন পেনসন-ভোগীদের আড্ডায় স্থান করে নিয়েছি।কি করে যে পার্কটির নাম “শ্রীলঙ্কা-পার্ক” হয়ে গেল আমি জানিনা। কিন্তু এখন শুধু এপাড়ায় নয় এই শহরের প্রায় সবাই জানে “লঙ্কা পার্কের” নাম-এমন কি পোস্ট অফিসের ঠিকানাতেও লেখে,”লঙ্কা পার্ক”। আসলে নাকি এই পার্কের(তখন পার্ক ছিলনা)স্থানে একটি “শ্রীলঙ্কার” ম্যাপের আকারের বড় পুকুর ছিল।কালক্রমে সেই পুকুর মজে-হজে গিয়ে এই পার্ক এর জমি তৈরি করে দিয়েছে-পরে স্থানীয় মিউনিসিপালিটি এখানে বয়স্কদের জন্য একটি পার্ক বানিয়ে দিয়েছেন।যদিও কিছু বালখিল্য “শচীন তেন্ডুলকার” ব্যাট-বল হাতে নিয়ে হাজির হয়ে দারোয়ানের তাড়া খেয়ে চলে যায়।তবে পার্কের এক নির্জন কোনে “সিনিয়র”দের জন্য ইংরাজি ‘ইউ’ অক্ষরের ন্যায় সাজানো তিনটি বেঞ্চ সকলেই সম্ভ্রমের সংগে ‘অনধিকার’ মেনে ছেড়ে দেয়।চকখড়ি দিয়ে আবার কে অপটু হাতে লিখেও দিয়েছে-“দাদু-দিদা স্পেশাল”। আগের পাড়ায় এ সুবিধে ছিলনা; খালি এক-চিলতে ঝুলানো বারান্দায় বসে নিচের রাস্তায় চলমান বিভিন্ন জাতের বাহনের মিছিল দেখাই ছিল একমাত্র নিঃশুল্ক মনোরঞ্জনের উপায়,তাই আজকাল রঙ-ধোওয়া বিকালেই এসে হাজির হই আমরা ক’জন এই লঙ্কা পার্কে।আমাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ বসন্ত-দা ওরফে বসন্ত সামন্ত সবার আগে এসে আসর সাজিয়ে বসে থাকেন।আশি ছুঁই ছুঁই অকৃতদার বসন্ত-দা প্রায়ই আসরের জন্য ঝাল-মুড়ি,চানাচুর,মশলা দেওয়া চিনে বাদাম ইত্যাদি নিয়ে আসেন।আমরা কিছু বললে প্রাণ খোলা হাসি হেসে বলেন,”আরে ভাই,পেনসনের টাকাগুলো খরচ না করলে মরার পর আবার যে সরকারের কাছেই ফেরত চলে যাবে”।


আমাদের মধ্যে সর্ব-কনিষ্ঠ সুশোভন হালদার জিজ্ঞেস জানতে চাইল,“সেটা কি ভাবে হবে বসন্ত-দা?”


“আরে ভাই আমার ত তিন কুলে বাতি দেবার কেউ নেই, টাকা গুলো ব্যাঙ্কে পড়ে থাকলে আমার মরার পরে আন-ক্লেইমড ফান্ড হিসাবে সরকারের কাছে চলে যাবেনা?” বলেই নিজের ঠাট্টায় হো হো করে হেসে ওঠেন।


এসব শুনতে আমাদের ভাল লাগেনা-সবাই একসঙ্গে আপত্তি জানাই “সে দিনের অনেক দেরি আছে দাদা,এখন থাকনা”।


“বেশ, থাক তাহলে-তোমাদের যখন ভাল লাগছে না শুনতে”, বলে ঝাল মুড়ি অথবা চানাচুরের প্যাকেট এগিয়ে দেন বসন্ত-দা।এহেন বসন্ত-দাকে এ-অঞ্চলের প্রায় সকলেই চেনেন কেবল আমার মত নবাগতরাই ওঁর সম্বন্ধে জানেনা।পোস্ট-অফিসের পোস্ট-ম্যানও বাড়ি খুঁজতে অসুবিধায় পড়লে বসন্ত’দার শরণাপন্ন হয়। আমি এসে নতুন ব্যবস্থা চালু করলাম,বসন্ত-দা ত এটা ওটা টুক-টাক খাবার নিয়েই আসেন আমরা এক এক জন এক একদিন ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে আসবে-তাতে করে ‘টা’ এর সঙ্গে ‘চা’ এর অভাবও দুর হয়ে যাবে।প্রস্তাবটা সবার মন মত হল-সবাইকে ফ্লাস্ক কিনতে হবেনা-একটা ফ্লাস্কই ঘুরতে থাকবে।


অন্যদিনের মত আজও পড়ন্ত বিকালে আমরা ক’জন জুটেছিলাম শ্রীলঙ্কা পার্কের নির্জন কোনে।কোনে হলেও ত্রিভুজাকৃতি পার্কের ‘ভার্টেক্স’ বা শীর্ষবিন্দুতে থাকায় আমাদের বেঞ্চগুলি থেকে শুধু পার্কেরই নয় দু’ধারের রাস্তারও পুরো দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হতো।আমাদের আসর বেশ জমে উঠেছিল এমন সময় পার্কের লাগোয়া মেটে রঙের পুরানো আমলের দোতলা বাড়িটা থেকে এক সম্পূর্ণ শুভ্র-কেশ, দীর্ঘদেহী অভিজাত সুপুরুষ,হাতে একটি সৌখিন ছড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমে এলেন।আমাদের দিকে নজর পড়তেই ভদ্রলোক ছড়ি-সহ দুহাত তুলে  আমাদের প্রতি নমস্কার জানালেন।একগাল হেসে বসন্ত’দা সেদিকে চেয়ে মাথা হেলিয়ে ঈসারা করলেন, “সব ভালো ত?”


ভদ্রলোক স্মিত হেসে বিনীত ভাবে হাত জোড় করে ঘাড় হেলিয়ে কুশল জানিয়ে রাস্তায় এগিয়ে চললেন। আগেও কয়েকবার


দেখেছি ভদ্রলোককে এইভাবে চলে যেতে-পরনে কোঁচানো ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি হাতে একটি দামী পাহাড়ি ছড়ি। ছড়িটির প্রয়োজন কম কিন্তু সৌখীন-মেজাজ  আর আভিজাত্যের পরিচায়ক বেশি।প্রায় একঘণ্টা পরে আমাদের আড্ডা যখন তুঙ্গে তখনই ভদ্রলোক ফিরে আসেন আর প্রায় আমাদের অগোচরেই ওঁর বাড়িতে ফিরে যান।অতএব আমাদের মধ্যে অনেকেই ওঁর ফিরে আসাটা দেখতে পান না।


ভদ্রতার খাতিরে কখনও বসন্ত-দাকে জিজ্ঞেস করার সাহস আমাদের কারও হয়নি।সবাই ভেবেছি একদিন বসন্ত’দা নিজেই এই রহস্যের পর্দা উন্মোচন করবেন।


সেদিন সন্ধ্যায় কি একটা সামাজিক অনুষ্ঠান থাকায় তাড়াতাড়ি আড্ডা ভেড়ে গেল-কেবল আমি আর বসন্ত-দা রয়ে গেলাম। কি হ’ল জানিনা,আমার মাথায় যেন ভুত চেপে গেল-ঠিক করলাম আজ বসন্ত-দা’র মুখ খুলিয়েই ছাড়ব।এই রহস্যময় মানুষটি সম্বন্ধে আরও কিছু জানতেই হবে।তাই আড্ডা শেষে সবাই বিদায় নেবার পরেও আমি এটা-ওটা কথা বলে টিকে রইলাম বসন্ত-দার সংগে।শেষে সুযোগ বুঝে ওঠালাম কথাটা,”আচ্ছা,দাদা একটা কথা অনেকদিন ধরেই মনে পুষে রেখেছি অথচ আপনাকে জিজ্ঞেস করার সাহস করে উঠতে পারছিনা”।


স্বভাব অনুসারে একগাল হেসে বললেন বসন্ত-দা, “কি এমন কথা যেটা আমাকে জিজ্ঞেস করতে পাচন আর তাতে মনে কষ্ট পাচ্ছ? আমার জীবনটা ত পাড়ার লাইব্রারিতে রাখা একটা খোলা বই ভাই,যে কেউ পড়ে নিতে পারে”।


আমি একটু গম্ভীর হয়ে বললাম, “না না দাদা,আপনার কথা নয়,আমি ভাবছিলাম ওই ভদ্রলোকের কথা”,বলে আমি আঙুল দিয়ে অদূরের দোতলা বাড়িটা দেখিয়ে দিলাম।


আমার কথার তক্ষুনি কোন জবাব না দিয়ে বসন্ত-দা একটু যেন গম্ভীর আর ভাবাবিষ্ট হয়ে ওই বাড়িটার দিকেই তাকিয়ে রইলেন।


নিজেকে সামান্য অপরাধী মনে হতে লাগল।মনে হল না জেনে হয়ত একটা অন্যায় আবদার করে ফেলেছি বা বসন্ত-দা’র  মনের কোন গোপন,কোন নরম স্থানে আঘাত করে ফেলেছি।ম্লান-মুখে তাই ফিস-ফিসালাম,“ না না,বসন্ত-দা কোন ব্যাপার নয়,অসুবিধা থাকলে আপনাকে কিছু ---”


আমাকে পুরোটা বলতে না দিয়ে বসন্ত-দা স্মিত হেসে খুব লঘুস্বরে বলে উঠলেন,“আরে না না ভাই তেমন কিছু ব্যাপার নয়;আমি ভাবছি কোথা থেকে শুরু করব,মানে,কোথা থেকে শুরু করলে তোমার মনে হবেনা আমি কোন গল্প-উপন্যাসের কাহিনী শোনাচ্ছি”।


আমি ওর ইতস্তত ভাবের কারণ বুঝতে পেরে সামান্য হেসে বললাম, “ দাদা,আপনার যেখান থেকে খুশি বলুন,ইচ্ছে না হলে বলবেন না-আমি কিছু মন করব না”।


এবার বসন্ত-দা আর কিন্তু কিন্তু করলেন না।সোজা শুরু করে দিলেন, “ এ পাড়ার আদি আর বনেদি পরিবার দত্ত চৌধুরী বংশের একমাত্র ওয়ারিশ জমিদার শঙ্কর নারায়ণ দত্ত চৌধুরী কেবল নামেই জমিদার রয়ে গেলেন-ঘাটে ঘটিও ডুবত না।তাই জমিদারী নাম বর্জন করে ছেলের নাম রেখেছিলেন অলিন্দ।জমিদারীর আয় না থাকলেও বাপ-ঠাকুরদার আমলের জমি-জমা থেকে আয় কম হতোনা।শঙ্কর নারায়ণের পরমাসুন্দরী স্ত্রী সুরবালা খুব কম বয়সেই তখনকার-দিনের-অজানা এক দুরারোগ্য রোগে মারা যান-মাথায় নাকি অসম্ভব ব্যথা হত,পরে জানা গিয়েছিল ওঁর ঘাড়ের নিচে শির-দাঁড়ায় নাকি টিউমার হয়েছিল।মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে উনি মারা যান-অলিন্দ তখন মাত্র সাত বছরের বালক।অলিন্দ পড়াশুনোয় আর খেলা-ধুলোয় দুইতেই ছিল তুখোড়।স্কুলে ওর খেলার সাথী অনেক থাকলেও পাড়ায় কিন্তু ওর একমাত্র সাথী ছিল পাঁচ বছরের ছোট খেয়া -ওর ঠাকুরদার আমলের জমিদারীর সরকার অনিল সরখেল এর নাতনি।দুই কিশোর-কিশোরীর স্নেহ ভালবাসা ছিল অপরিসীম-ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠেই ওরা ফুল-ফল কুড়োতে ছুটত দত্ত পুকুরে।এককালে এই দত্ত-পুকুর দত্ত চৌধুরী পরিবারেরই সম্পত্তি ছিল।এই দত্ত পুকুর ছিল বড় একটি দীঘি আর আর চারপাশে নানা জাতের ফল আর ফুলের বাগান।এই দীঘির পাড়ে একটি বড় আমলকীর গাছ ছাড়াও ছিল আমা,জাম,কয়েত-বেল,নারকেল আর তালের গাছ।দুই কিশোর-কিশোরীর ‘নেশা’যেন ছিল সকালে ঘুম থেকে উঠেই ওখানে দৌড়ান আর ফল-ফুল দিয়ে কোঁচড় ভরা।কুড়ানো ফুল-ফল কিন্তু দুজনের কেউই বাড়ি নিয়ে যেতোনা-ফেরার পথে সেগুলো বিলিয়ে দিয়ে খালি হাতেই ফিরত।সব সময়েই ওদের একসঙ্গে দেখা যেতো।সবাই তাই আদর করে ওদের ডাকতো,“খেয়া-অলি”।সেটাই ক্রমে ক্রমে লোকের মুখে হয়ে দাঁড়ালো “খেয়ালী”।


একনাগাড়ে অনেকক্ষণ বলে বসন্ত-দা এবার থামলেন।ওনার কাঁধের ব্যাগ থেকে ছোট জলের বোতলটি বের করে কয়েক ঢোক জল খেয়ে নিয়ে আমাকেও ঈসারা করলেন;আমি মাথা নেড়ে ‘না’ করলাম।আমার তখন জলের তৃষ্ণা ছেড়ে গল্পের নেশা ধরে গেছে।স্মিত হেসে পাঞ্জাবির আস্তিনে মুখ মুছে আবার শুরু করলেন,“স্কুলের পড়া শেষ হতেই শঙ্কর নারায়ণ ছেলেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিলেত পাঠিয়ে দিলেন।ওখানে থাকা কালীন ঠিক করলো সে বড় ডাক্তার হবে আর তার মা যে রোগে মারা গেছেন সেই রোগেরই বড় ডাক্তার হবে। নামী নিউরোসার্জন হয়ে ১৬ বছর পরে দেশে ফিরে এলো অলি।ততদিনে শঙ্কর নারায়ণ গত হয়েছেন।দেশে এসেও কত যে মানুষকে বাঁচিয়েছেন তার সীমা-সংখ্যা নেই।প্রথমে কলকাতার হাসপাতালে পরে নিজেই নার্সিং হোম খুলে কম খরচে ওই রোগের চিকিৎসা আর প্রয়োজনে অপারেশন করত।


ওদিকে অলিন্দ বিলেত চলে যাওয়ার পর খেয়া যেন কেমন হয়ে গেল।তাকে কেউ আর বাইরেই দেখতে পেল না।শুধু খুব কাছের মানুষগুলি ওকে দেখতে পেলো ওর বিয়ের রাতে।পরের দিন পরমাসুন্দরী খেয়া গ্রাম,বাড়ি,দেশ ছেড়ে স্বামীর ঘর করতে চলে গেল সুদূর নিউজিল্যান্ডে।“ বসন্ত-দা এবার থেমে গেলেন আর যেন কোন গল্পই বাকি নেই। আমি রাস্তার ল্যাম্প-পোষ্টের স্বল্প আলোকে উন্মুখ হয়ে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।


সময় চলে যেতে আর সন্ধ্যা এগিয়ে গিয়ে রাত হতে লাগল তবু বসন্ত-দা নীরব।


অনেক পরে আবার একটু জল খেয়ে শুরু করলেন, “সবই ঠিক -ঠাক চলছিল কিন্তু হঠাৎ একদিন পরেশ-দাস যে ছিলেন ও বাড়ির আত্মা-সুরবালার মৃত্যুর পরও সব কিছু ঠিক-ঠাক চলছিল যার জন্যে সেই পরেশ দাস-ভৃত্য কম বাড়ির প্রাণ আর আত্মা বেশি, অসুস্থ হয়ে পড়ল।ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা গেল ওর মাথার পিছন দিকে একটি টিউমার বাসা বেঁধেছে।হয়েছিল অনেক দিনই,কিন্তু বলেনি কোনদিন।অলিন্দ হেসে বলল,”আরে ভয় কিসের পরেশ-দা অমন টিউমার আমি প্রতিদিন কম করে দু’টো বের করে আনি;তোমারটা ত আমি দু’ঘণ্টার মধ্যে বের করে আনব”।বসন্ত-দা আবার চুপ করে গেলেন।


“তুমি ত জান কি সূক্ষ্ম কাজ এটি-একটি ছোট নার্ভ কেটে গেলে রুগী জীবনের মত পঙ্গু হয়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকবে”, খুব ধীরে রাতের হাওয়ার ন্যায় ফিসফিসিয়ে বললেন বসন্ত-দা।


আবার একটু থেমে এক ঢোক জল খেয়ে শুরু করলেন, “ভগবানের কি ইচ্ছা ছিল জানিনা-ঠিক ওইদিনই জীবনে প্রথমবার হাত কেঁপে গেল অলিন্দ’র।সাহায্যকারী ডাক্তার আর নার্সরা চোখ কপালে তুলে দেখল টিউমার কেটে পিচকারির মত রক্ত বেরুতে লাগল। অনেক চেষ্টা করেও আর কিছু করতে পারল না অলিন্দ।পরেশ জীবনের মত পঙ্গু হয়ে গেল-আজও বিছানায় শুয়ে। অলিন্দই এখন ওর সেবা করে।সেইদিন থেকে এত-বড় সার্জেন আর ছুরি হাতে নেয়নি।পরিবর্তে হাতে তুলে নিলো পরেশ এর সেবা আর আঁকার ব্রাশ আর তুলি”।এবার বসন্ত-দা একেবারেই চুপ হয়ে গেলেন।


“একবার কেবল একবার ওর লাইব্রারিতে উঁকি মারার সুযোগ এসেছিল।সমস্ত দেওয়াল শুধু একটি মানুষের মুখের ছবিতে ভরা।সেই মানুষটির বাল্য,কৈশোর,প্রাক-যৌবন,যৌবন,প্রাক-যৌবন,বার্ধক্যের ছবি।বয়সের সঙ্গে মানুষের মুখের কি পরিবর্তন হয় তার হুবহু বর্ণনা করে আঁকা ওই ছবিগুলো। ছবিগুলো ভিন্ন কিন্তু মুখ একটি-একই মানুষের মুখ কিভাবে পরিবর্তিত হয় বয়সের সঙ্গে।অপূর্ব সুন্দর আর নিখুঁত সে সব ছবি।সে মুখটি কার জান?”


গল্পের মাঝেই বসন্ত-দার প্রশ্নে আমি অবাক হয়ে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম- আর আমার অজান্তেই বাঁয়ে-ডাঁয়ে মাথা নাড়লাম,“না”।


মুহূর্ত-কাল থেমে বসন্ত-দা ম্লান হেসে বললেন, “সে মুখ,অলি’র বাল্য-কৈশোরের সাথী খেয়ার”।


আমি অবাক হয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। 


সন্ধ্যার ছায়া ছায়া অন্ধকার মিলিয়ে গিয়ে জোনাক-জ্বলা রাত হয়েছিল, আমরা দু’জন ছাড়া আর ত কেউ ছিলনা আর এরপর অন্য গল্প জমবার কথাও হয়না,তাই ভাবছিলাম এবার উঠে পড়ব ঠিক সেই সময় একটা বকের মত সাদা বড় গাড়ি যেন বড় ডানা মেলে এসে থামল রাস্তার উপর।আমরা দু’জনে একটু অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম-এ রাস্তাতে সাধারণত খুব বেশি গাড়ি যাতায়াত করেনা-বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে। যে লোকটি চালাচ্ছিল সে বেরিয়ে এসে পিছনের দরজা খুলে ঘাড় বেঁকিয়ে কিছু বলতেই এক সাদা-পাকা চুল মাথার মহিলা বেরিয়ে এলো।ভদ্রমহিলা শাড়ি সামলে,মাথার এলো-মেলো চুলগুলোকে সামান্য বিন্যস্ত করে নিয়ে চোখের চশমাটা ঠিক করে নিলেন।রাস্তার কম-পাওয়ারের হলদে আলোতে একবার চারদিক পরখ করে নিলেন-মনে হ’ল কারও বাড়ি খুঁজছেন।এ অঞ্চলে ত বাড়ির নম্বর দেওয়া নেই তাই বুঝি বুঝতে পারছেন না।রাস্তায় আর কোন লোক না থাকায় আমি ভাবছিলাম এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করব কিনা কার বাড়ি খুঁজছেন-আমি না জানলেও বসন্ত-দা নিশ্চয়ই জানবেন,সেই সময়েই ড্রাইভার ভদ্রলোক আমাদের পানে এগিয়ে এসে বিনীত ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “আছা স্যার এখানে দত্ত পুকুর বলে জায়গাটা কোথায় হবে বলতে পারেন?”


আমি লোকটিকে যখন জরিপ করছিলাম ততক্ষণে বসন্ত-দা উঠে দাঁড়িয়েছেন, “দত্ত-পুকুরে কোথায় যাবেন ভাই”?


নামটা বোধহয় ওর জানা ছিলনা তাই পিছন দিকে তাকিয়ে ভদ্রমহিলার পানে চাইল।ততক্ষণে উনিও এগিয়ে এসেছেন আমাদের পানে।রাস্তার আলো ওঁর পিছনে থাকায় মুখটা পরিষ্কার দেখা গেলনা-কিন্তু এটুকু বুঝতে অসুবিধা হ’লোনা যে মহিলা বেশ সম্ভ্রান্ত ঘরের আর খুবই সপ্রতিভ।


বসন্ত-দা এগিয়ে এসে বয়স্ক মানুষের মত চোখের দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করে বলে উঠলেন, “দত্ত-পুকুর ত এখন নেই ,মজে-হজে গিয়ে ছোট একটি ডোবা মতন আছে ; ক্ষমা করবেন মা, আমি বৃদ্ধ মানুষ তায় রাস্তার আলোও কম,কিন্তু তুমি কি আমাদের খেয়া?অলিন্দকে খুঁজছ?”


হঠাৎ যেন আকাশ ফেটে বাজ পড়ল।সেই আলোতে ভদ্রমহিলা অপলক দৃষ্টিতে বসন্ত-দা’র পানে তাকিয়ে রইল-মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুলো না।


অনেক পরে মহিলা খুব ক্ষীণ-কণ্ঠে বলে উঠলেন,”হ্যাঁ,কিন্তু “।


এবার বসন্ত-দা স্বভাব-সিদ্ধ একগাল হেসে বলে উঠলেন,” আমাকে তুমি চিনতে পারবেনা,কিন্তু আমি তোমাকে চিনেছি”।


“কি করে চিনলেন?আমি ত পঁয়ত্রিশ বছর পরে এলাম এদেশে?”


মুচকি হেসে বসন্ত-দা খুব ধীরে ধীরে বলে উঠলেন, “যে মানুষটা প্রতিদিন তোমাকে দেখে আর তার ঘরে সাজিয়ে রাখে তার আঁকা ছবিতেই তোমাকে দেখেছি খেয়া।“


“কে সে ?”,অবাক হয়ে প্রশ্ন করল খেয়া।


“এই বিরাট পৃথিবীতে সে যে একটি মানুষই আছে-সে তোমার বাল্য আর কৈশোরের সাথী-অলিন্দ।অলিন্দ দত্ত চৌধুরী”।


“অলিদা ?অলিন্দ? কোথায় কোথায় পাব তাকে?আমি যে তার খোঁজেই এসেছি?”আকুল হয়ে প্রশ্ন কর’ল খেয়া।


স্মিত হেসে মাথা দুলিয়ে বললেন বসন্ত-দা ,“আমি জানিগো মা,তুমি ছাড়া আর কে করবে তার খোঁজ? সে ও যে তোমারই খোঁজে জীবন কাটিয়ে দিল”।


হাত বাড়িয়ে মেটে রঙের দো’তলা বাড়িটার আলোকিত জানালার দিকে আঙুল দেখিয়ে বসন্ত-দা আবার বললেন, “ওই দেখ, তোমার অলি,সারা রাত জেগে তোমারই ছবি আঁকছে,ওর ঘরেই ত আমি আজকের তোমাকে দেখেছিলাম,তাই ত এত সহজে এত কম আলোতেও তোমাকে চিনতে আমার কষ্ট হ’লনা”।


বসন্ত-দা তার কথা শেষ করার আগেই খেয়া  দৌড়াতে আরম্ভ করেছিল-মেটে রঙের দোতলা বাড়িটার দিকে।


সেদিকে তাকিয়ে আমিও ম্লান হেসে বলে উঠলাম, “চলুন দাদা এবার আমরা বাড়ি যাই”।


“হ্যাঁ,চল ভাই, এতদিনে আমারও পথ দেখা সফল হল”। 

 


আমি অবাক হয়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে ওঁর হাত ধরে অন্ধকার পার্কের রাস্তায় এগিয়ে চললাম।



No comments