DEHLIJ

আলী আফজাল খান

ভাষা ও জিন: অস্ট্রিক এবং দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের সাথে বাংলা ভাষার আত্মীয়তা



আশির দশকের শেষের দিকে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ পরিবারের সদস্যদের (KE Family) মধ্যে সর্বপ্রথম ভাষাগত সক্ষমতার সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। পরিবারটির সন্তান-সন্ততিরা Elizabeth Augur-এর পশ্চিম লন্ডনের বিশেষায়িত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় সমস্যাটি ধরা পড়ে। অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে যে, পরিবারটির কথা বলার সমস্যা তিন প্রজন্মে বিদ্যমান এবং ৩০ জন সদস্যের মধ্যে ১৬ জনই ঠিক মতো ভাষা ব্যবহার করতে পারে না। পরিবারটির সদস্যদের মধ্যে কারও সমস্যাটি কম, কারও গুরুতর, আবার কারও একদম নেই। আক্রান্তরা উচ্চারণ সম্পূর্ণ করতে পারত না, সীমিত শব্দ ভাণ্ডার, বিশেষত ব্যঞ্জনবর্ণ উচ্চারণ করতে পারত না। ১৯৯০ সালে বিজ্ঞানী Marcus Prembey and Jane Hurst পরিবারটির নমুনা বিশ্লেষণ করে গবেষণার মাধ্যমে সমস্যাটি বংশগত বা জিনগত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। ২০০১ সালে Faraneh Vargha-Khadem  যে জিনটি ভাষা সক্ষমতা তৈরি এবং উৎকর্ষতায় জড়িত সেটা আবিষ্কার করেন এবং নাম দেন FOXP2 (FORKHEAD BOX P2),, মানুষের অনন্য বৈশিষ্ট্য ভাষার ব্যবহারের জন্য দায়ী ‘ভাষা জিন’ (language Gene) FOXP2 আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে এক নতুন দিগন্ত উন্মেচিত হয়। বিবর্তনের ধারায় প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে মানুষের এই জিনে এমন মিউটেশন হয় যাতে মানুষ ভাষা ব্যবহারের অনন্য সক্ষমতা অর্জন করে। [১]

পরবর্তীতে গবেষণায় দেখা যায়, বস্তুত শুধুমাত্র একটি জিন মানুষের ভাষা সক্ষমতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে না এবং বৈজ্ঞানিকভাবে এটি প্রমাণিত যে, কয়েকটি জিন সমষ্টি মানুষের ভাষা সক্ষমতা তৈরিতে ভূমিকা রাখে। কিন্তু এটাও সত্য FOXP2 জিন মানুষকে অন্যান্য প্রাণীগোষ্ঠী থেকে ভাষাগত দিক দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন উন্নত প্রাণী হিসেব দাঁড় করিয়েছে। এই বিশেষ জিনটি যদিও মানুষসহ অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণী যেমন শিম্পাঞ্জী, পাখি ইত্যাদির মধ্যে বিদ্যমান, কিন্তু চমৎকার বিষয় হচ্ছে মানুষের FOXP2 জিনে কমপক্ষে দুটি জায়গায় (এমিনো এসিড) ভিন্নতা আছে, এই মিউটেশন শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই হয়েছে, যার ফলে জিনটি মস্তিষ্কের ৬৫টির বেশি জায়গা প্রভাবিত করে। ফলে মস্তিষ্কে যোগাযোগের উন্নত ব্যবস্থা ভাষা সক্ষমতা তৈরি হয়েছে মানুষের। [২]

ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের FOXP2 এর প্রকাশ বেশি যে কারণে দেখা যায় মেয়ে শিশুদের ছেলে শিশুর তুলনায় ভাষাগত দক্ষতা বেশি। FOXP2 জিন যে জিনটিকে প্রভাবিত করে সেটিও বৈজ্ঞানিকরা আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছেন, জিনটির নাম SRPX2. [৩]

Humans have a unique natural ability to develop highly complex linguistic systems- an ability that lies in our genes but is also shaped by our different environments. We can learn languages from others and use them to share our thoughts, feelings and desires; languages are the foundation of society, culture and science. What is so special about our genetic make-up that allows us to use language? How does the ability relate other higher cognitive functions like human memory and mathematical or musical ability?

জিন শব্দটা শুনলেই মনের অজান্তেই আমাদের মনে এক অজানা রহস্যের সৃষ্টি হয়। মনে হয় শৈশবকালের দাদা দাদির কাছে গা ছমছম কথা, ডানা কাটা পরী ও জিনের গল্প। আমাদের বর্তমান আলোচনার জিন আর শৈশবের রহস্যময় জগতে বা বিশ্বাসের পরাজগতের জিন এক নয়।

যখন কোনো নবজাতক গগন বিদারি চিৎকারে ভূমিষ্ঠ হয় তখন থেকেই আমরা ব্যস্ত থাকি নবজাতকটি কার মতো হয়েছে, কেউ হয়ত নবজাতকের নাকের সাথে মায়ের নাকের সাদৃশ্য খুঁজে পায়, আবার কেউ নবজাতকের চোখের সাথে বাবার মিল খোঁজে। কেউ হয়তো অবয়ব বিশ্লেষণে নবজাতকের গায়ের রং বা গঠনে খুঁজে পায় দাদা দাদি বা নানা নানির মিল।

আমরা অনেক সময় শুনে থাকি তোমার এই প্রাণ খোলা হাসিটা ঠিক তোমার বাবার মতো। আবার এইও শুনি তোমার বাবা শৈশবকালে ঠিক তোমার মতো দূরন্ত ছিল। অর্থাৎ গঠন অবয়ব বা বৈশিষ্ট্য বংশানুক্রমে প্রবাহিত হয়। আর এটাই বংশগতি, আমরা আমাদের বৈশিষ্ট্য পেয়েছি আমাদের মা-বাবার কাছ থেকে, আবার আমাদের মা-বাবারা পেয়েছে তাদের মা বাবার কাছ থেকে। বৈশিষ্ট্যের যে প্রবাহ তা আসলে জিনেরই প্রবাহ। অর্থাৎ জিন প্রবাহিত হয় মা-বাবা থেকে সন্তান-সন্ততিতে। জিন আসলে একটা বৈশিষ্ট্য কোড করে। একটি ইমারতের গঠন একক যদি ইট হয় তবে আমাদের দেহের ইট হচ্ছে কোষ। অর্থাৎ আমরা হচ্ছি আমাদের দেহ কোষের সমষ্টি। আমাদের দেহকোষের সব কার্যকলাপের সমষ্টি হচ্ছে আমাদের এক একজনের কার্যকলাপ। অর্থাৎ আমাদের জীবন হচ্ছে আমাদের দেহকোষের সব প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়ার মূল।

আমাদের দেহ কোষের আকার দেহের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম। চোখের কোষ এক রকম আবার কিডনি বা হৃদযন্ত্রের কোষ অন্য রকম। কোষের নিজস্ব আভ্যন্তরীন গঠন বিন্যাস আছে। কোষকে আমরা এভাবে কল্পনা করতে পারি, থকথকে কিছু জেলির ন্যায় পদার্থ পর্দা দ্বারা আবৃত। জেলির মধ্যে একটি গোলাকার বস্তু ভাসমান যাকে আমরা নিউক্লিয়াস বলি। যদি কোষকে ডিমের সাথে তুলনা করি তাহলে কুসুম হচ্ছে নিউক্লিয়াস। আসলে ডিমও এক প্রকার কোষ। এই নিউক্লিয়াসের ভিতর প্যাঁচানো কিছু সুতো থাকে যাকে ক্রোমোসোম বলে। ক্রোমোসোম হচ্ছে ডিএনএ নামক সুতা, প্রোটিন আবরণ দিয়ে প্যাঁচানো থাকে। অর্থাৎ ক্রোমোসোম থেকে প্রোটিন সরিয়ে নিলে যা থাকে তাই হচ্ছে ডিএনএ।

আমাদের প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়া পরিচালিত হয় এনজাইমের মাধ্যমে, আর এনজাইম হচ্ছে প্রোটিন। আমরা যে খাবার খাই, তা বিভিন্ন ধরনের এনজাইমের মাধ্যমে বিপাক হয়। আমাদের যে চামড়ার রং তাও এক ধরনের প্রোটিনের কারণে। গায়ের রং মেটা মেলানিন নামক রঞ্জক প্রোটিনের কারণে। মেলানিনের আধিক্য বেশি হলে গায়ের রং কালো হয়। আবার মেলানিন কম থাকলে গায়ের রং ফর্সা হয়। অর্থাৎ আমাদের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ নির্ধারিত হয় প্রায় দুই লাখের মতো প্রোটিন দ্বারা।

জিন হচ্ছে ডিএনএ এর একটি অঞ্চল যা একটি নির্দিষ্ট প্রোটিনকে কোড করে। অর্থাৎ আমাদের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ জিনের মধ্যে কোড করা থাকে। ডিএনএ আবার চার ধরনের ইট দিয়ে গঠিত। এই ইটগুলোকে নিউক্লিওটাইট বলে- এডিনিন, গুয়ানিন, থাইমিন এবং সাইটোসিন। এদের ক্রমবিন্যাস হচ্ছে জেনেটিক কোড। মানুষে মানুষে জেনেটিক কোডের যেমন সাদৃশ্য আছে তেমনি বৈসাদৃশ্যও আছে। তাইতো কারও চোখ কালো আবার কারও চোখ নীলাভ। কারও কন্ঠ সুরেলা আবার কারও কন্ঠ কর্কশ।


জাতিগতভাবেও জিনের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আছে। যেমন চীন বা জাপানের লোকদের দৈহিক অবয়ব আর বাঙালিদের অবয়ব এক নয়। দুটি জাতির জেনেটিক সাদৃশ্য যদি বেশি থাকে তবে তাদের দেহ অবয়ব বা আচার আচরণের মিল বেশি থাকে। জেনেটিক সাদৃশ্যতা দিয়ে একটি জাতির আদি পুরুষ কোথা থেকে এসেছে তা বোঝা যায়। অর্থাৎ কোনো জাতির মাইগ্রেশন প্যাটার্ন বোঝা যায়।

যদি ধরে নেয়া হয় সৃষ্টির আদিতে মানুষের জিন একরকম ছিল, তাহলে সময়ের সাথে জিনগুলো ক্রমবর্ধমান বিবর্তনের বা পরিবর্তনের কারণেই মানুষে মানুষে বা জাতিতে জাতিতে এত বৈচিত্র্যতা।

টোনের (Tone) উপর ভিত্তি করে ভাষাকে ভাগ করা যায়। প্রত্যেক ভাষাতেই স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জণবর্ণ ব্যবহার করা হয় এবং শব্দ থেকে অন্য শব্দকে পৃথক করার জন্য টোনযুক্ত ভাষা যেমন চৈনিক ভাষা পিচ (Pitch) ব্যবহৃত হয় শব্দের শেষে, অন্যদিকে টোনবিহীন ভাষায় পিচ (যেমন ইংরেজি) ব্যবহৃত হয় বাক্যের শেষে। পিচ বা ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করা হয় আবেগ ও গুরুত্ব বোঝানোর জন্য। সাব সাহারা অঞ্চলের ভাষা টোনযুক্ত, অন্যদিকে ইউরেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার ভাষা টোনবিহীন। বিজ্ঞানীরা (Tone) টোনযুক্ত ও টোনবিহীন ভাষার সাথে জিনের সম্পর্ক দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রে তারা দৃষ্টি দিয়েছেন মস্তিষ্কের গঠনের বৃদ্ধি ও উৎকর্ষের (Growth and development) সাথে জড়িত দুটি জিন। জিন দুটি হচ্ছে ASPM এবং Microcephalin.

আমাদের মানব কোষে প্রত্যেকটি জিন জোড়ায় জোড়ায় থাকে। একটি আসে বাবার কাছ থেকে অন্যটি আসে মায়ের কাছ থেকে। জোড়া জিন দুটির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য থাকতে পারে এবং এদেরকে আলাদাভাবে ঐ জিনের Allele বলে। অর্থাৎ সাধারণভাবে কোনো জিনের Allele দুটি। কিন্তু যখন বিস্তৃত জনসংখ্যার সাথে তুলনা করা হয় তখন ঐ জনগোষ্ঠীর কোনো জিনের অনেক Allele থাকতে পারে। কোনো জিনের ভিন্নরূপকেই Allele বলা হয় ।

কোনো একটি নির্দিষ্ট Allele এর ফ্রিকোয়েন্সি একক জনগোষ্ঠীতে একেক রকম। ধরা যাক কোন জিনের ‘ক’ নামক Allele এর ফ্রিকোয়েন্সি বাঙালি জাতীতে ৭০% তা হয়তো চীনা জাতিতে ৩০%, Allele ফ্রিকোয়েন্সি বিশ্লেষণ করেও জাতিগত সাদৃশ্য তুলনা করা হয়। ASPM জিন এর একটি Alleleহচ্ছে ASPM-D, অন্যদিকে Microcephalin (MCPH 1) এর একটি Allele MCPH-D, এই দুটি Allele Gi এর ফ্রিকোয়েন্সি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, টিউনবিহীন ভাষার জাতিতে এদের ফ্রিকোয়েন্সি বেশি। অন্যদের টিউন ভাষাতে এ জিন দুটির ফ্রিকোয়েন্সি কম। [৪]

পৃথিবীর আদি মানব গোষ্ঠীকে নৃবিজ্ঞানীরা প্রধান চারটি গোষ্ঠীতে ভাগ করেছেন। সেই চারটি গোষ্ঠী হল অস্ট্রেলীয়, মঙ্গোলীয়, ককেশীয় ও নিগ্রীয়। তবে নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা বাঙালি সম্প্রদায়ের উৎপত্তি অস্ট্রেলীয় গোষ্ঠী দ্বারা। এই অস্ট্রেলীয় সম্প্রদায় থেকে আদি হতে আজ পর্যন্ত বহু রক্তের মিশ্রণ ঘটেছে। সেই মিশ্রণে বহু সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হয়েছে। আবার অনেক সম্প্রদায় হারিয়েও গেছে। আদি গোষ্ঠীর ধারায় আমরা অনেক সম্প্রদায়ের মিশ্রণে আজকের শংকর জাতি। 


প্রাচীন বাংলার জনপদে অনেক সম্প্রাদায় বিদ্যমান ছিল। তবে, এই সম্প্রায়ের ভেতর বাংলা ভাষাভাষী অস্ট্রিক সম্প্রদায়ই ছিল সবচেয়ে বেশি। বাংলা ভাষাভাষী অস্টিক সম্প্রদায় ছিল আদী অস্ট্রেলীয় গোষ্ঠীর উপজাতি। ধারণা করা হয়, আদি অস্ট্রেলীয় গোষ্ঠী বাংলায় প্রবেশ করে প্রায় ৫-৬ হাজার বছর পূর্বে। বাংলাদেশের বর্তমান কিছু সম্প্রদায়ের সাথে আদি অস্ট্রেলীয় সম্প্রাদায়ের মিল খুজে পাওয়া যায়। তাদের ভেতর সাঁওতাল, বাঁশফোড়, কোল, মুন্ড্, ভীম, মালপাহাড়ি, চন্ডাল ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মিল খুজে পাওয়া যায়। তবে কয়েকজন নৃবিজ্ঞানী ধারনা করেন যে, বাঙালি জাতির রক্তে মঙ্গোলয়েড জাতি গোষ্ঠীর রক্ত বিদ্যমান আছে।

পুরো বাঙালি জাতিকে দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা হয়। একটি আর্য অন্যটি অনার্য। অস্ট্রেলীয় নরগোষ্ঠীর বাংলা ভাষাভাষী অস্ট্রিক উপজাতির পর বঙ্গ অঞ্চলে আগমন ঘটে আর্য সম্প্রদায়ের। প্রাচীন বঙ্গদেশে আর্যদের আগমনের পূর্বে অনার্য গোষ্ঠীদের বাঙালি জাতির আদি পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর এই অনার্যরা হলো আদী অস্ট্রেলীয় গোষ্ঠীর অস্ট্রিক উপজাতি। অর্থাৎ আর্যদের আগমনের পূর্বে বঙ্গদেশে অবস্থানকারী অস্ট্রেলীয় গোষ্ঠীর বাংলা ভাষাভাষী অস্টিক উপজাতি ও তাদের কিছ কাল পরে আগমনকারী সম্প্রদায়দের বলা হয় অনার্য।

আমরা জেনেছি বাঙালি জাতির পূর্ব পুরুষ হলো, বাংলা ভাষাভাষী অস্ট্রিক উপজাতি। অস্ট্রিক উপজাতির পর প্রাচীন বঙ্গদেশে অনার্য জাতির আগমন ঘটেছে সেই গোষ্ঠীকে বলা হয় দ্রাবিড় গোষ্ঠী। দ্রাবিড় গোষ্ঠীর প্রাচীন বাংলায় আগমন ঘটার পর তারাও বাঙালির পূর্ব পুরুষের সাথে মিশে যায়। ধারনা করা হয় বঙ্গদেশে দ্রাবিড়দের আগমন ঘটে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে। দ্রাবিড় গোষ্ঠীর আগমনের পর আরেকটি গোষ্ঠীর আগমন ঘটে। তাদেরকে বলা হয়, আলপাইন গোষ্ঠী।

বাঙালি জাতি গোষ্ঠী ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশে গুজরাটি ও মারাঠী সম্প্রদায়ের রক্তের সাথে মিশে যায় আলপাইন গোষ্ঠী। এছাড়া দক্ষিণ চীন থেকে আগত মঙ্গালয়েড সম্প্রদায়ের আগমনের ধারনা পাওয়া যায় পার্বত্য চট্রগ্রাম, রংপুর, সিলেট অঞ্চলের মানুষের বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করে। এই অঞ্চলের মানুষের সাথে মঙ্গালয়েড গোষ্ঠীর মানুষের শারীরিক বৈশিষ্টের মিল খুজে পাওয়া যায়। আর্যদের আগমনের পূর্বে বঙ্গদেশে আসা অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গালয়েড, আলপাইন জাতিদের বলা হয় অনার্য।

আর্যদের আগমন সম্পর্কে নৃবিজ্ঞানীদের ধারনা হলো, ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় ৩৫০০ বছর আগে আর্যদের আগমন ঘটে। তবে উপমহাদেশে ৩৫০০ বছর আগে আর্যদের আগমন ঘটলেও বঙ্গদেশে তাদের আগমন ঘটে আরো অনেক পরে। ধারনা করা হয় বঙ্গদেশে আর্যদের আগমন ঘটে প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালে। আর্যদের আগমনের পর এই অঞ্চলের সামাজিক ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। আর্য জাতি এই অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।

মানুষের ভাষার বিকাশ ঘটেছে তিনটি ধাপে। প্রথমত; ধ্বনিগত ও দেহভাষার স্তর, যে স্তরে মানুষ কিছু সীমিত ধ্বনি আর অঙ্গভঙ্গি দিয়ে অর্থ বিনিময় করেছে। দ্বিতীয়ত; শব্দমূলগত স্তর, যে স্তরে মানুষ যৌগিক ধ্বনির বিন্যাস দিয়ে অনেক শব্দ তৈরি করে, সেগুলোর অর্থ নিষ্পত্তি করে ব্যবহার করা শুরু করেছে বার্তা আদান-প্রদানের জন্য। তৃতীয়ত; বাক্য স্তর যেখানে মানুষ শব্দগুলো জটিল ব্যাকরণিক সূত্র দিয়ে গাঁথবার মধ্য দিয়ে আরও জটিল ভাব আদান-প্রদানের সামর্থ্য অর্জন করেছে। বিবর্তনবাদী আলোচনায় বাক্যের চেয়ে শব্দের প্রতি বেশি মনোযোগ দেয়া হয়। পরবর্তীতে কাঠামোবাদী ভাষাবিজ্ঞান সেই ঘাটতি পুষিয়ে দিয়েছে। বিবর্তনবাদীদের অনুমান, এই সবকিছুই ঘটতে সময় লেগেছে প্রায় ১০ লাখ বছর। বিবর্তনের সূত্রে সময়কালের যে ধারণা তাতে এটা মনে হয় খুব বেশি সময় নয়। ভাষা বৈচিত্রকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রেও বিবর্তনবাদী ধারায় বহু আলোচনা রয়েছে। এই প্রশ্নে মানুষের উৎসমূল আর ভাষার উৎসমূলের আলোচনা প্রায় একই রকম। এখানে মৌলিক দুটি ধারণার একটি হচ্ছে পৃথিবীর ভাষাগুলো বিভিন্ন জায়গায় স্বতন্ত্রভাবে বিকশিত হয়েছে। অন্যটি হচ্ছে একটি অভিন্ন ভাষা থেকে পৃথিবীর সব ভাষার উদ্ভব ঘটেছে। এই দুই অনুমানেই ভাষার জায়গায় মানবজাতি বসিয়ে নিলেও আলোচনার ছকের খুব একটা হেরফের হয়না। [৫]

গত একশত পঞ্চাশ বছর যাবৎ ভাষাবিদরা ভাষার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে পৃথিবীর সব ভাষাকে কয়েকটি ভাষা বর্গে বা পরিবারে ভাগ করেছে। পণ্ডিতগণ একই পরিবারের শ্রেণীসমূহ থেকে কিছু মৌলিক শব্দ তুলনা করে শ্রেণীসমূহের সম্পর্ক নিরূপণ করেছেন। বেশির ভাগ ভাষাই কোনো না কোনো ভাষা পরিবারের অন্তর্গত। বিশ্বে প্রায় ১০০টিরও বেশি ভাষা পরিবার বিদ্যমান। [৬]

উলে¬খযোগ্য ভাষা পরিবারগুলি হচ্ছে:

১ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার

২ উরালীয় ভাষা পরিবার

৩ আলতায়ীয় ভাষা পরিবার

৪ চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবার

৫ মালয়-পলিনেশীয় ভাষা পরিবার

৬ আফ্রো-এশীয় ভাষা পরিবার

৭ ককেশীয় ভাষা পরিবার

৮ দ্রাবিড় ভাষা পরিবার

৯ অস্ট্রো-এশীয় ভাষা পরিবার

১০ নাইজার-কঙ্গো ভাষা পরিবার

ইন্দো-ইউরোপিয়ান বর্গে মধ্যে ইউরোপের প্রায় সব দেশের এবং ভারত, বাংলাদেশ, ইরান ও আফগানিস্তানের ভাষা অন্তর্ভুক্ত। প্রায় দুইশত জীবিত ভাষা এই বর্গের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত বলে এখন অব্দি ভাবা হয়। এই ভাষা পরিবারটির অন্তর্গত ভাষাতেই পৃথিবীর সর্বাধিক মানুষ কথা বলে এবং এই ভাষা পরিবারের উপরেই সবচেয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে। বাংলা ছাড়া এই ভাষা পরিবারের অন্তর্গত ভাষাগুলোর মধ্যে আছে ইংরেজি ভাষা, স্পেনীয় ভাষা, পর্তুগিজ ভাষা, ফরাসি ভাষা, ইতালীয় ভাষা, জার্মান ভাষা, সুয়েডীয় ভাষা, রুশ ভাষা, গ্রিক ভাষা, ফার্সি ভাষা, পশ্তু ভাষা, উর্দু ভাষা, সিন্ধি ভাষা, হিন্দি ভাষা, গুজরাটি ভাষা, পাঞ্জাবি ভাষা, মারাঠি ভাষা, ওড়িয়া ভাষা, অসমীয়া ভাষা। এছাড়াও আছে ধ্রুপদী ভাষা যেমন সংস্কৃত ভাষা, লাতিন ভাষা ও আদি পারসিক ভাষা।



ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোকে চারটি প্রধান শাখায় ভাগ করা যায় :


ক. ইন্দো-ইরানীয় ভাষাসমূহ

খ. রোমান্স ভাষাসমূহ

গ. জার্মানীয় ভাষাসমূহ

ঘ. বাল্টো-স্লাভীয় ভাষাসমূহ


যে আদি ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি তা অন্তত তিনহাজার বছরের পুরনো। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের একটি হলো ভারতীয় আর্যভাষা। ঋগ্বে¦দের মন্ত্রে যে আর্যভাষা পাওয়া যায় তার নাম প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা, যা লিখিত হয়েছিল যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও এক হাজার বছর আগে। বেদের শ্লোকগুলোকে তার অনুসারীরা পবিত্র ভেবে মুখস্থ করে রাখত; ফলে সেগুলো থেকে যায় প্রায় অবিকৃত, কিন্তু অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা বদলে যেতে থাকে। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে একসময় বৈদিক ভাষা দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। সে সময়ে ব্যাকরণবিদরা, বিশেষ করে পাণিনির মতো জগদ্বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ, নানা নিয়ম বিধিবদ্ধ করে একটি মানসম্পন্ন ভাষা সৃষ্টি করেন, যার নাম ‘সংস্কৃত’। ‘সংস্কৃত’ শব্দটির অর্থই হলো পরিশীলিত বা বিধিবদ্ধ। বাংলায় প্রচুর সংস্কৃত শব্দের উপস্থিতি দেখে আগে ধারণা করা হতো বাংলা বুঝি সংস্কৃত থেকেই উদ্ভূত বা এর কন্যা। সংস্কৃত ছিল সমাজের উঁচুশ্রেণীর মানুষের লেখার ভাষা, আড়ম্বরপূর্ণ এবং নিয়মের নিগড়ে বাঁধা। এ ভাষায় মানুষ কথা বলত না, মানুষ কথা বলত কথ্য ভাষায়- যার নাম ‘প্রাকৃত’। এই প্রাকৃত ভাষা থেকেই উদ্ভব ঘটেছে বাংলার। সে সময়ে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন ‘প্রাকৃত’ ভাষায় কথা বলত। ভাষাতত্তবিদ জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসনের মতে, বাংলার উদ্ভব হয়েছে মাগধী প্রাকৃত থেকে। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মত কিছুটা ভিন্ন। তাঁর মতে, বাংলার উৎপত্তি ঠিক মাগধী থেকে নয়, বরং এর অপভ্রংশ থেকে, যার নাম মাগধী অপভ্রংশ। ড. মুহম্মদ শহীদুলহ অবশ্য মনে করেন বাংলা যে প্রাকৃত থেকে উদ্ভূত হয়েছে তার নাম গৌড়ি প্রাকৃত। তিন ভাষাপণ্ডিতই যে বিষয়ে একমত তা হল সংস্কৃত নয়, বাংলার আদি জননী হলো প্রাকৃত। [৭]

জেনেটিক ট্রি এবং ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রি [৮] তুলনা করলে দেখা যায়, একই ভাষাভাষি জনগোষ্ঠীর মধ্যে জিনগত সাদৃশ্য উচ্চমাত্রার। সাধারণভাবে তাই ধরে নেয়া যায় যে, একই ভাষাভাষি জনগোষ্ঠীর ভাষা ও জিনের বিবর্তনের কালিক ইতিহাস অভিন্ন। যদিও ইতিহাসের বিশাল কালখণ্ডে কিছু কারণ প্রভাবিত করেছে ব্যতিক্রম তৈরিতে, এই ভিন্নতার কারণ হতে পারে দুইভাবে:

১. ভাষা প্রতিস্থাপন (Language Replacement):

অনাবাসী ও অল্প জনবহুল কোনো এলাকায় দ্রুত বর্ধনশীল কোনো জনগোষ্ঠীর অধিগ্রহণে ভাষা প্রতিস্থাপন হতে পারে। যেমন ঘটেছে নিউ গায়েনা, অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকার ক্ষেত্রে। ব্যাপক হারে অভিবাসী বসতি স্থাপনে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা তাসমেনিয়া এবং ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ হতে সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য অভিবাসনের পরও আদিবাসীরা তাদের ভাষাটি বাঁচিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছেন (Basques, Lapps, Eskimas, Khoisam) । এক্ষেত্রে অবশ্য প্রাগৈতিহাসিক সময়ে জনবসতির অভিবাসন ছিল কৃষি ব্যবস্থাপনার বিস্তারের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এবং শান্তিপূর্ণ। যদিও আদিবাসী, অভিবাসীদের মধ্যে আন্তঃবিবাহ সম্পর্কের কারণে ভাষা ও গড় জিনোটাইপের কিছু পার্থক্য তৈরি হয়েছে।

২. জিন প্রতিস্থাপন (Gene Replacement):

প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীর ধারবাহিক জিন প্রবাহের কারণেই জিন প্রতিস্থাপন ঘটে। জিন প্রতিস্থাপনের আদর্শ দৃষ্টান্ত হচ্ছে আফ্রিকান/ব্লাক আমেরিকানরা। পূর্ব পুরুষদের তুলনায় ব্লাক আমেরিকানদের গায়ের রং উজ্জ্বল হয়। জিন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আফ্রিকানদের গড়ে ৩০% জিন পোল ইউরোপিয়ান থেকে, এক্ষেত্রে (শ্বেত আমেরিকান) জিন থেকে এসেছে আংশিক প্রতিস্থাপন ঘটেছে গত ৩০০ বছরে। এই হারে জিন প্রতিস্থাপন ঘটতে থাকলে আগামী ২০০০ বছরে আফ্রিকান আমেরিকানদের জিন পুলে পূর্বপুরুষদের জিন থাকবে মাত্র ৯%।



চিত্র: ভাষা পরিবার [৯]


Figure: Map of Bangladesh showing the sampling area and suggested geneflow from different directions. [১০]


বাংলাদেশে বসবাসরত উপজাতিগুলোর মধ্যে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জাতির (এদের বর্তমানে ব্যবহৃত ভাষা তিব্বতো-বার্মা ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, ধারণা করা হয় ভাষা পরিবারটি চীন থেকে জন্ম নিয়ে বার্মা এবং বৃহত্তর হিমালয় অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে) জিন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের তিব্বতো-বার্মা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং ভারতের তিব্বতো-বার্মা ভাষাভাষি জনগোষ্ঠীর সাথে জিনগত মিল বহন করছে এবং ভাষাগত জাতীয়তা রয়েছে। [১১]

কোনো জাতির জিনগত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হয় উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে, বাঙালী জাতির জিনগত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে এ ধরণের প্রথম গবেষণা করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইটোকন্ড্রিয়াল DNA (মাতৃতান্ত্রিক বিশ্লেষণ) এবং ওয়াই (পিতৃতান্ত্রিক বিশ্লেষণ) ক্রোমোসোম বিশ্লেষণ করে। বাংলাদেশের ডিএনএ ল্যাবের বৈজ্ঞানিকগণ পপুলেশন জেনেটিক বিজ্ঞানী প্রফেসর শরীফ আক্তারুজ্জামানের নেতৃত্বে (National forensic DNA profiling Laboratory) বাঙালি জাতির ক্রোমোসোম নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং অন্যান্য জাতীর  ক্রোমোসোমের সাথে বাঙালী জাতির একটা তুলনামূলক গবেষণা দেখিয়েছেন। সেই গবেষণায় দেখা যায়, তিব্বতসিনো ভাষা গোষ্ঠীর যেমন চায়না, কোরিয়ান, জাপান এদের জেনেটিক সাদৃশ্যতা অন্য ভাষা গোষ্ঠীর তুলনায় অনেক বেশি।[১২] 

আবার বাংলা ভাষী জনসংখ্যার জেনেটিক সাদৃশ্যতা অস্ট্রিক, ইন্দো-ইউরোপীয়ান এবং দ্রাবিড় ভাষা গোষ্ঠীর জাতির সাথে মিল বেশি। দেখা গেছে  বাঙালি জাতির ক্রমোসোমের সাথে ভারতীয় দক্ষিণের তামিল জাতি (দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত), পাঞ্জাবি জাতির (ইন্দো-ইউরোপীয়ান পরিবারের অন্তর্ভুক্ত)  এবং গাদ্দি (অস্ট্রিক ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত) [১৩] উপজাতির সাথে মিল বেশি। বাঙালী জাতির ডিএনএ সবচেয়ে বেশি মিলেছে গাদ্দিদের সাথে, তারপর পাজ্ঞাবী এবং তামিলদের সাথে। কে জানে হয়তো গাদ্দি, তামিল, পাঞ্জাবী ও বাঙালীর আদি পুরুষ একই। হয়ত বাঙালিদের মাইগ্রেশন দক্ষিণ ভারতের তামিল অথবা পাঞ্জাব থেকেই হয়েছে অথবা তামিলদের মাইগ্রেশন বাংলাদেশ থেকে হয়েছে। 
আমরা ইতিমধ্যে জানি, বাংলা ভাষার মতো পাঞ্জাবি ভাষাও ইন্দো ইউরোপিয়ান ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। বাংলা ভাষার সাথে পাঞ্জাবী ভাষার আত্মীয়তার বিষয়টি তাই আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত। ভাষাবিদরা হয়তো ভবিষ্যতে গবেষণা করবেন বাংলা ও তামিল এবং বাংলা ও গাদ্দি ভাষার সাথে কতটা মিল রয়েছে। তামিল ভাষা দ্রাবিরিয়ান ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এবং গাদ্দি ভাষা অস্ট্রিক ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। বাংলা যেহেতু প্রকৃত ভাষা থেকে জন্ম নেয়া ভাষা, খুব সম্ভব যে অস্ট্রিক ভাষা পরিবার এবং দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের সাথেও বাংলার শিকড় ছড়িয়ে আছে। এ বিষয়ে কিছু আলাপ করে তাই প্রবন্ধটি শেষ করব। 

দ্রাবিড় ভাষাসমূহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রচলিত ৭৩টি ভাষার একটি পরিবার। এই ভাষাগুলোতে প্রায় ২২ কোটি লোক কথা বলেন। তেলুগু, তামিল, কন্নড় ও মালয়লম চারটি প্রধান দ্রাবিড় ভাষা। বাকি ভাষাগুলোর মধ্যে গোন্ডি, তুলু, কুরুখ উলে¬খযোগ্য।

দ্রাবিড় ভাষাগুলো মূলত ভারতের দক্ষিণ, পূর্ব ও মধ্য অঞ্চলে প্রচলিত। ভারতের বাইরে শ্রীলংকাতে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগর, পূর্ব আফ্রিকা ও অন্যান্য প্রবাসী দ্রাবিড় সম্প্রদায়েও এগুলি প্রচলিত। দ্রাবিড় ভাষাগুলোর মূল অঞ্চল থেকে অনেক দূরে পাকিস্তানে ব্রাহুই নামের দ্রাবিড় ভাষাটিতে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ লোক কথা বলেন।



চিত্র: দ্রাবিড় ভাষাসমূহের বিস্তার।

তামিল অত্যন্ত প্রাচীন একটি ভাষা। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে এতে রচিত সাহিত্যের নিদর্শন পাওয়া গেছে। দ্রাবিড় ভাষাগুলোর মধ্যে তামিলের সাহিত্যই সবচেয়ে প্রাচীন এবং এটি অনেকটা সংস্কৃতের সমতুল্য। ব্রাহ্মণ ও অ-ব্রাহ্মণদের বলা তামিল ভাষার মধ্যে পার্থক্য আছে, অর্থাৎ তামিল ভাষা কেবল ভৌগোলিকভাবেই নয়, সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ীও ভিন্ন হতে পারে। এছাড়া আনুষ্ঠানিক তামিল ভাষা ও কথ্য তামিল ভাষার মধ্যেও বড় পার্থক্য বিদ্যমান।

দ্রাবিড় ভাষার প্রভাব বাংলা ভাষায় পড়েছে, পন্ডিতেরা আমাদের শব্দভান্ডারে দ্রাবিড় ভাষা থেকে আগত বেশ কিছু শব্দ এবং বাক্যগঠন রীতিতে দ্রাবিড় ভাষার প্রভাব লক্ষ্য করেছেন। তবে তা কতটুকু সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে আর কতটুকু সরাসরি দ্রাবিড় ভাষা থেকে প্রাপ্ত, তা এখনও গবেষণার বিষয় বস্তু। সুনীতকুমার চট্টোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন যে বাংলা ভাষার গঠন, বাক্যরীতি, উচ্চারণ ও শব্দ ভান্ডারে অবশ্য দ্রাবিড় প্রভাব আছে, কিন্তু এই ধরনের ঐক্য কেবল বাংলা ভাষাতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সকল নব্য ভারতীয় আর্য ভাষায় রয়েছে।

ঋগবেদে ৭৩টি দ্রাবিড় শব্দ খুঁজে পাওয়া গেছে, রেভ. কল্ডওয়েল, গুন্ডার্ট আর কিটেল সাহেবের মত এটা। সম্প্রতি বাংলা ভাষার দ্রাবিড় শব্দসমূহ নিয়ে ভাষা গবেষক শ্রী অসীত দাস বেশ কিছু নতুন উপাত্ত আমাদের উপহার দিয়েছেন তার প্রণীত বই 'নামধামের উৎসকথা' য়। তার গবেষণায় কিছু বাংলা শব্দের দ্রাবিড় উৎসের হদিস তাঁর ভাষায় এখানে উল্লেখ করলাম- 

পয়লা বৈশাখ:
পয়লা শব্দটির উৎস কী? ১) জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালা ভাষার অভিধান' মতে সংস্কৃত 'প্রথম' থেকে হিন্দি পহিল্লা বা পহেলা হয়ে বাংলায় এসেছে পয়লা। ২)পাশা খেলার এক নম্বর দান হল 'পোয়া'। তাই আমরা বলি পোয়া বারো। পোয়া থেকে পোয়ালা হয়ে পয়লা। বাঙালির প্রাচীন অভ্যাসের চিহ্ন। ৩)তামিল ভাষায় পয়লু মানে ফসল। ওখানে ফসল ওঠার সময়। পয়লু থেকেই পয়লা। 

চিনা রসুন বনাম চিনা বাদাম:
চীনক মানে চীনদেশীয় ধান। চীন তো সংস্কৃত বলেই বেশির ভাগ অভিধানে লেখা আছে। তবে যে শব্দগুলি দ্রাবিড়ভাষা থেকে সংস্কৃতে গৃহীত হয়েছে তার একটা তালিকা দিয়েছেন কল্ডওয়েল ও কিটেল সাহেব। পড়লে চমকে উঠতে হয়- অক্কা, অগুরু, অঙ্ক, অঙ্কুর, অটবী, অধর, অনল, অম্বা, অট্টালিকা, অরবিন্দ, অরণি, অলক, অলস,তাম্বুল, কঠিন, কঠোর, কবরী, কবল, কমল, কর, করোটি ইত্যাদি। মোট আশিটি। আমরা যে দেশকে চিন বলি, চিনারা নিজেরা তাকে বলে চুঙ্কুয়া। তাহলে 'চীন' নিশ্চিতভাবে বাংলাকরণ বা ভারতীয়করণ। ফার্সিয়াকে পারস্য, ইটালিকে ইটলি, ইউরোপকে ইয়োরোপ বলার মত। চিনা মানে সবাই চিনদেশীয় বোঝালেও এর আর একটি অর্থ আছে। দ্রাবিড়ভাষায় 'চিন্না' মানে ছোট। চেন্নাই, চিন্নাস্বামী মানে যথাক্রমে ছোট শহর ও ছোটকর্তা। চিনে বাদাম, চিনে চিংড়ি, চিনে জোঁক মানে ছোট প্রজাতির বাদাম, চিংড়ি ও জোঁক। চিনা রেশম, চিনা রসুন, চিনা ধান অবশ্য চিনদেশীয়। চিনাবাজারের ব্যাপারটা বিতর্কের অবকাশ রাখে। বড়বাজারের পাশে বলে ছোটবাজার তথা চিনা বাজার বলা হত প্রথমে। পরে কাকতালীয়ভাবে সেখানে চিনদেশীয় লোকেরা এসে বাস করে। অনেকে বলেন তামিলভাষা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ভাষা। তাহলে কি চিনদেশের বামনাকৃতি বা ছোটচেহারার লোককে দেখে প্রথমে তামিলে দেশটিকে চিন্না বা চিন বলা হয়? সংস্কৃতে এল তামিল থেকেই কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হয়ে? চিন এই ভাবেই চীন হল? বাংলা ও অন্যান্য ভাষায় চিন (চীন) বলা হয় দেশটিকে এবং পরে সেইদেশের বাসিন্দারা চিনা বা চিনে বলে পরিচিত হল।

নলিয়ান, নলেন
নলেন গুড়কে নলিয়ান থেকে জাত বলেছেন একমাত্র হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ( তবে মূল হচ্ছে নব বা নওল)। অন্য সব অভিধানে সরাসরি নলেন বলা হয়েছে। যে ছটি অভিধান দেখেছি তাতে কোথাও দ্রাবিড় ব্যুৎপত্তির কথা নেই। আমি তখন আজকাল কাগজে দ্রাবিড় শব্দ থেকে আগত বাংলা শব্দ নিয়ে লিখছি। শ্রদ্ধেয় একরাম আলি আমাকে একটি বই দিয়েছিলেন। ড সত্যনারায়ণ দাশের লেখা 'বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ'। সেখানে নরক আর নরুন শব্দের ব্যুৎপত্তিতে তামিল নরকু শব্দের কথা বলা হয়েছে। নরকু মানে কর্তন বা কাটা।(প্রসঙ্গত নরিয়ান বা নলিয়ান সেখানে ছিল না)। এই ধরনের আরও শব্দ আছে কিনা দেখার জন্যে বঙ্গীয় শব্দকোষ দেখলাম। নরসানি বা নরসিং কাটারির নাম পেলাম। পেলাম 'নারীচ' তীরের নাম। 'নরসুন' একটি বাউল গানে পেয়েছিলাম (সুধীর চক্রবর্তীর গভীর নির্জন পথে বইয়ে)। খুর অর্থে ব্যবহার। সেটা কিন্তু উক্ত অভিধানে নেই। নলিয়ান বা নলেন দেখলাম গুড় অর্থে। তখনই ভেবেছিলাম নলিয়ান শব্দটিও মনে হয় এসেছে নরিয়ান থেকে। নরিয়ান হতে পারে খেজুর রসের কারবারি বা শিউলিদের কাতান বা হাঁসুয়া। এই হেঁসো দিয়ে গাছ চাঁছা হয় বলে রস তথা রস থেকে প্রাপ্ত গুড়ের নামও নলিয়ান বা নলেন হয়ে গেল।

নরসুন্দর:
নাপিতকে বলে নরসুন্দর। কেননা তিনি নরকে কামিয়ে সুন্দর করে তোলেন। নরসুন মানে নাপিতের খুর। নরসুন শব্দটির ব্যবহার বাউলগানে পেয়েছি। এটি নরকু নামক তামিল শব্দ থেকে আগত, অনেক কর্তন যন্ত্রের একটি। নরসানি বা নরসিং কাটারি, নরুন, নারিচ(তীরের ফলা), নরিয়ান( কাতান বা হেঁসো) ইত্যাদি হল অন্যান্য যন্ত্রগুলি। নরসুন দিয়ে কাজ করা যার পেশা, সেই হল নরসুনদার। মানে নাপিত। ঝাড়ুদার, বেলচাদারের মতো। 




ইতুপূজা

চিন্তাহরণ চক্রবর্তী 'হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠান' বইয়ে ইতু শব্দটিকে মিত্র শব্দের অপভ্রংশ ধরেছেন। মিত্র অর্থাৎ সূর্যের উপাসনা বলেছেন ইতুপুজোকে। আবার পল্লব সেনগুপ্ত তাঁর 'পূজাপার্বণের উৎসকথা' বইয়ে ঋতু থেকে ইতু-র উৎপত্তির কথা ভেবেছেন। ঋতু এখানে দ্ব্যর্থক।

আমি ডঃ সত্যনারায়ণ দাশের 'বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ' বইটিতে দেখেছিলাম ইতু শব্দটি তামিল ও কন্নড় ভাষায় আছে। মানে বাচ্চা বা শিশু। ইতুপুজো আসলে প্রজননের ইচ্ছা পূরণের পুজো। বাচ্চাকাচ্চার মুখ দেখার পুজো।
ও বঙ্গে ইতুপুজোর বদলে আছে চুঙ্গীর পুজো। চুঙ্গী এসেছে তামিল চিন্না বা চুন্না থেকে। মানে ছোট, শিশু অবস্থা। অর্থাৎ ইতুপুজো ও চুঙ্গীর পুজো মূলগতভাগে একই। প্রজননের দেবীর আরাধনাই বলা যায়। মা ষষ্ঠীর সঙ্গে কিছুটা মিল আছে বৈকি! প্রসঙ্গত আমাদের লৌকিক দেবদেবীরা অনেকেই দ্রাবিড়-অস্ট্রিক সভ্যতার চিহ্ন বহন করে।

বাড়াভাত, আই-বাড়াভাত, আইবাড়ভাত ও আইবুড়োভাত
গায়েহলুদের পর আইবুড়োভাত (আইবড়ভাত)। অভিধানমতে আইবুড় এসেছে অব্যূঢ় থেকে। মানে অবিবাহিত। প্রচলিত ব্যাখ্যা হল, অবিবাহিত অবস্থায় পাত্রপাত্রী শেষ খাওয়া খায় এই অনুষ্ঠানে। অব্যূঢ়ান্ন থেকেই এই আইবুড়োভাত।

বঙ্গীয় শব্দকোষ জানাচ্ছে 'আই' এর একটি অর্থ মা (তামিল/মারাঠি)। 'আইবুড়োভাত' হল মায়ের বাড়া ভাত। যতই আত্মীয়রা খাওয়ান, শেষেরটা মা।

আবার, তামিল ভাষায় 'আই' মানে মা বা দিদিমা। 'আইবুড়ী' বলে বাংলায় একটি কথাই আছে দিদিমা-বুড়ী বোঝাতে। তাহলে কি বহুকাল আগে মা বা দিদিমার হাতে ভাত বেড়ে দেওয়ার চল ছিল গায়ে হলুদের পরের এই অনুষ্ঠানে? আমাদের বাঙালি আচার-অনুষ্ঠানে অনেক দ্রাবিড় অনুষঙ্গ আছে। কারণ বাঙালি আদতে দ্রাবিড়-অস্ট্রিক মিশ্র জাতি। তাই আই অর্থে মা বা দিদিমার মত বয়স্কদের বাড়া ভাতকে আইবুড়ভাত বলা যেতেও পারে। অর্থাৎ 'আই-বাড়াভাত' থেকে অপভ্রংশে হল আইবড়ভাত তথা আইবুড়োভাত।

আবার, আইয়ো বা এয়ো মানে সধবা বধূ। আইয়োসুয়ো মানে সধবা ও সুভগা (সৌভাগ্যবতী)। আইয়ো বা এয়োদের বাড়া ভাত কিনা সেটিও দেখতে হবে। কারণ আগের অনুষ্ঠান গাত্রহরিদ্রা বা গায়েহলুদ হল এয়োদের অনুষ্ঠান। সধবারাই সেই অনুষ্ঠানে অংশ নেন। তাহলে আইবুড়ভাত কি আসলে আইয়োবড় বা আইয়োবাড়া ভাত?

আইবুড়ো বা আইবড়কে অব্যূঢ় (অবিবাহিত) বলে মেনে নিতে কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়। সে তো কতই বলা হয় বয়স্ক বিবাহযোগ্য যুবকযুবতীদের। জীবনানন্দ দাশ তো 'আইবুড়ো ভিখারি'ও লিখে গেছেন! গোল বাধছে 'আইবুড়োভাত' নিয়েই!

বাড়াভাত আমাদের দেশজ সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে। প্রবাদ আছে 'বাড়াভাত পায়ে ঠেলতে নেই'। 'আই' মানে দ্রাবিড়ে, মারাঠিতে, অসমিয়ায় 'মা'। আইবাড়াভাত মানে মায়ের বাড়া ভাত। অপভ্রংশে আইবড়ভাত বা আইবুড়ভাত। আইবুড়োভাত বা আইবড়োভাত আসলে বিয়ের আগে মায়ের হাতে শেষ ভাত বা অন্ন মুখে তোলা। বাড় বা বাড়বাড়ন্ত শব্দটির মূলেও তামিল শব্দ বাড়্। মানে উন্নতি। ছেলে বা মেয়ের উন্নতির আকাঙ্ক্ষায় তাকে ভাত খাওয়ান মা। আইবাড়ভাত থেকেও আইবড় বা আইবুড়োভাত আসতে পারে। মায়ের অবর্তমানে দিদিমা খাওয়ানোর কাজটি করতেন। অথবা দিদিমার অবর্তমানে আইয়া বা এয়োরা করতেন। শুভকাজে আইয়া বা আইয়ো তথা এয়োদের ডাক পড়ে। পণ্ডিতরাই যখন ধন্ধে, কেউ বলছেন 'অব্যূঢ়-ভাত', কেউ বলছেন তা নয়, এটি হল 'আয়ুর্বৃদ্ধি-ভাত', আমরাই বা যাই কোথায়! প্রাকবৈদিক এই দ্রাবিড় লোকাচারের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গতি নেই। [১৪]

দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের ভৌগোলিক বিস্তার দেখলে আপাতত মনে হয়, বাংলা ভাষা ও তামিল ভাষা নিকটাত্মীয়ই, জেনেটিক বিশ্লেষণে প্রাপ্ত তথ্য বিরোধাভাসমূলক মনে হয় না।
বাংলা ভাষায় অস্ট্রিক ভাষার উপাদানের অস্তিত্বও অনুরুপভাবে প্রমাণ করে যে বঙ্গীয় জনগণের সঙ্গে অতি প্রাচীনকালেই অস্ট্রিকভাষী জনগোষ্ঠীর সংযোগ ঘটেছিল এবং স্বল্প হলেও আধুনিক বাঙালী জন সৃষ্টিতে অস্ট্রিক উপাদানের  অবদান রয়েছে। [১৫] ডিএনএ বিশ্লেষণেও বাঙালীদের সাথে গাদ্দিদের জিনের মিলই সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশে এখন ছাব্বিশটির মতো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বাস করে। এদের ভাষার মধ্যে ওঁরাও, খাসিয়া, গারো, চাকমা, মগ, মণিপুরী, মুক্তা ও সাঁওতালি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও রয়েছে খুমি, কোচ, হাজং, চাক, খাড়িয়া, খিয়াং, তঞ্চঙ্গ্যা ইত্যাদি।

ওঁরাও ভাষা: 
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও সিলেটের চা-বাগান এলাকায় প্রায় লক্ষাধিক লোকের মাতৃভাষা ওঁরাও। ওঁরাও ভাষীদের সর্বোচ্চ সংখ্যা রংপুরে এবং সর্বনিম্ন সিলেটে। ওঁরাও ভাষা কুরুখ নামে সমধিক পরিচিত। এ ভাষার কোন লিখিত রূপ নেই, তবে তা লোকসাহিত্য সমৃদ্ধ। ওঁরাও ভাষায় অসংখ্য উপকথা, রূপকথা, গীত, ছড়া, ধাঁ ধাঁ প্রবাদ ইত্যাদি রয়েছে।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে মুন্ডা ও ওঁরাও ভাষা একই। ওঁরাও ও বাংলা ভাষায় কিছু গহনার নাম এক, যথা- টিকলি, বালা, পায়রা, বালি, কানপাঁশা ইত্যাদি। সম্বন্ধসূচক অনেক ওঁরাও এবং বাংলা শব্দও এক যথা- মা, বাবা, মামা-ভাগিনা ইত্যাদি। এ ছাড়াও কিছু বাংলা শব্দ ও ওরাঁও শব্দের মধ্যে যথেষ্ট মিল দেখা যায় যথা- ওঁরাও ভাগোয়ান, বাংলা ভগবান, ওঁরাও ভগতি, বাংলা ভক্তি, ওঁরাও ভূত, বাংলা ভূত ইত্যাদি।

খাসিয়া ভাষা: 
খাসিয়া ভাষা অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। খাসিয়া ভাষায় গ্রামকে ‘পুঞ্জি’ বলে। সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ও পার্বত্য অরণ্য অঞ্চলে তাদের বসবাস। খাসিয়া ভাষার মধ্যে রয়েছে প্রধানত পাড়, লিংগাম ও ওয়ার। পাড় মানে পর্বত ও খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ের পূর্বাংশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রচলিত ভাষাই পাড়। লিংগাম শব্দে গারো পাহাড়কে বোঝায়। তাই গারো পাহাড়ের সন্নিকটের অঞ্চলের ভাষাই লিংগাম নামেই সমধিক পরিচিত। ওয়ার মানে উপত্যকা।

এক সময় খাসিয়া ভাষা বাংলা হরফে লিখিত হতো। বাংলা অক্ষরে বাইবেলের কিছু অংশ খাসিয়া ভাষায় প্রথম অনূদিত হয়েছিল। বর্তমানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খ্রীস্টান মিশনারিদের প্রচেষ্টায় রোমান অক্ষরে চেরাপুঞ্জি ও এতদঅঞ্চলের খাসিয়া ভাষা লিখিত হচ্ছে। মেঘালয় রাজ্য এ ভাষাকে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম করা হয়েছে। বাংলাদেশে খাসিয়াদের জনসংখ্যা অত্যধিক নয়। সিলেট বিভাগের বিভিন্ন পার্বত্য ও অরণ্য অঞ্চলে তাদের বসবাস।

গারো ভাষা :
 গারো ভাষা প্রধানত চীনা-তিব্বতী ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এবং অনক্ষর ও অলিখিত একটি প্রাচীন অনার্য ভাষা। চীনা ভাষার সঙ্গে এ ভাষার শব্দ, ব্যাকরণ ও ভাষা তত্ত্বগত প্রচুর মিল রয়েছে। এ ভাষা প্রবাদ-প্রবচন, স্লোক, গান, ছড়া, কিংবদন্তি, উপকথা, পালাগান ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ। এতে নৃতত্ত্ব ও ধর্মের কথাও আছে। বহু ভাষার শব্দ দ্বারা গারো ভাষার শব্দকোষ পুষ্ট। এ ভাষার বাক্য গঠন, পদ বিন্যাস, বিভক্তি, প্রত্যয়ের অবস্থান, ক্রিয়া ও শব্দের রূপান্তর উন্নত ভাষার মতো সুশৃঙ্খল। বাংলা ও অসমীয়া ভাষার সঙ্গে এ ভাষার সাদৃশ্যের কারণে কেউ কেউ গারো ভাষাকে এই দুই ভাষার মিশ্ররূপ বলে মনে করেন। গারোরা বিভিন্ন জেলায় বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করে বলে এ ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ দেখা যায়। খ্রীস্টান মিশনারিরা গারো ভাষায় রোমান অক্ষর প্রচলন করেন। বাংলা হরফে গারো ভাষা স্বচ্ছন্দে লেখা যায়। বর্তমানে গারোদের পারিবারিক ভাষা গারো কিন্তু তাদের পোশাকি ভাষা বাংলা। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও ভারতের মেঘালয় সীমান্তে রয়েছে গারোদের বসবাস।



চাকমা ভাষা : 
চাকমা ভাষা বাংলাদেশের উপজাতীয় ভাষাসমূহের মধ্যে উন্নততর। এ ভাষায় কিছু প্রাচীন পুঁথি রয়েছে। সে সবের মধ্যে তালপাতায় লিখিত ‘চাদিগাং চারা’ পালা একটি। এ থেকে জানা যায় যে চাকমারা নেপাল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা দেশ পরিক্রম করে ব্রহ্মদেশ ও আরাকানের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে উপনীতি হয়। প্রাচীনকাল থেকেই এখানে তাদের আনাগোনা থাকলেও মাত্র তিন শ’ বছর পূর্বে তার পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তাদের আদিনাম ‘শাক’ (ঞঝ ধশ)। পার্বত্য চট্টগ্রামে তিন লক্ষাধিক লোক চাকমা ভাষায় কথা বলে। চাকমা ভাষার বর্ণমালা থাইল্যান্ডের ক্ষের, আন্নাম, লাওস, কম্বোডিয়া, শ্যাম ও দক্ষিণ ব্রহ্মের লিপির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

চাকমা ভাষায় চীনা ভাষার মতো টান  আছে, যে কারণে একই শব্দের অর্থ পার্থক্য ঘটে, তবে তা তেমন প্রকট নয়। শব্দতত্ত্ব, ছন্দ প্রকরণ লোকসাহিত্য, বাগ বিন্যাস ও ধ্বনিতত্ত্বের দিক দিয়ে চাকমা ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার খুব মিল রয়েছে। বাংলা ভাষার সব ধ্বনি চাকমা ভাষায় রয়েছে। রাঙ্গামাটি থেকে ‘চাকমা প্রথম পাঠ’ নামে একটি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটির প্রণেতা নয়ন রাম চাকমা।

চাকমা ভাষায় রচিত অনেক গীতও আছে, যেগুলো চাকমা কথ্য ভাষায় রচিত। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে চাকমা কবি শিবচরণ রচিত ‘গোজেল লামার’ ভাষা প্রায় হুবহু বাংলা, এতে ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকার’ মতো বন্দনা গীতি রয়েছে। ‘রাধামন ধানপাতি’ ও ‘চাদিগাং চারা’ পালা চাকমাদের দুটি উল্লেখযোগ্য পালা। চাকমা ও বাংলা ছড়ার ছন্দ প্রায় অভিন্ন। এ দুটি ভাষার পদবিন্যাসও প্রায়ই একই রকম।

মগ ভাষা : 
মগ ভাষা হলোÑ আরকানী ভাষার কথ্যরূপ এবং একটি সংকর ভাষা। তিব্বতী-বর্মণ গোষ্ঠীভুক্ত এ ভাষায় অসেট্রা-এশীয় ভাষার প্রচুর উপাদান রয়েছে। চীনা, প্রাচীন বর্মী এবং মিজো ভাষার সঙ্গে এ ভাষার যথেষ্ট মিল রয়েছে। তবে সবচেয়ে বর্মী ভাষার সঙ্গে রয়েছে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। মগ ভাষার আদিনিবাস আরাকান। বাংলাদেশে দুই লক্ষাধিক লোক মগ ভাষায় কথা বলে।

মগ ভাষা আরাকান ও বাংলা ভাষার সংমিশ্রিত ভাষা। এক সময় ব্রহ্মদেশীয় রাজার অত্যাচারে দুই-তৃতীয়াংশ আরাকানী বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ করেছিল। ফলে তাদের ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার সংমিশ্রণে মগ ভাষার উৎপত্তি হয়।

মগ বর্ণমালার নাম ‘ঝা’। বর্ণগুলো মানুষের কোন না কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নামে উচ্চারিত হয়। এর আকৃতিতে চীনা চিত্রলিপির ছাপ লক্ষণীয়।

আরাকান ও বাংলাদেশেও এক শ্রেণীর মগ আছে। যাদের ভাষা বাংলা। বড়ুয়ারা মূলত মগ, কিন্তু বাংলাভাষী। পালি মগদের ধর্মীয় ভাষা। এ কারণে বহু পালি শব্দ কিছুটা বিকৃত কিংবা অবিকৃতভাবেই মগ ভাষায় প্রবেশ করেছে। যেমনÑ ভিক্ষু, নির্বাণ, বিহার, ভাবনা (ধ্যান), দুক্্খ, বস্্সা (বর্ষা) ইত্যাদি।
বাংলা ও মগ ভাষার কিছু কিছু শব্দ উচ্চারণ ও অর্থে এক, যথা : আদ্য, মধ্য উপাধি, আপত্তি ইত্যাদি। আত্মীয় সূচক কিছু মগ শব্দ বাংলায় ব্যবহৃত হয়, যা উচ্চারণ ও অর্থে এক। আবার কোন কোনটিতে অর্থের কিছু তারতম্য ঘটেছে, যথা : বাবা, বাজী, মা। আঞ্চলিক বাংলায় বাবা, বাজী সমার্থক, কিন্তু মগ ভাষায় বাজী মানে জেঠা। মগরা ছোট মেয়েকে বলে ‘মা;, কিন্তু আঞ্চলিক বাংলায় মেয়েকে আদর করে বলা হয় ‘মা’।

বর্মী ও মগ ভাষায় বার ও মাসের নাম এবং সংখ্যা গণনা অভিন্ন। মগরা আরাকানে থাকতেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত ছিল, কারণ মধ্যযুগে আরাকানে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের চর্চা হতো। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, ফরিদপুর ও বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা ও মগ ভাষার মধ্যে পারস্পরিক প্রভাব লক্ষণীয়।

মুন্ডা ভাষা : 
মুন্ডা অস্টো-এশিয় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এবং ভারতীয় আর্য ভাষা থেকেও প্রাচীনতর। এ ভাষা উড়িয়া, অসমিয়া ও বাংলা ভাষার প্রাথমিক ভিত রচনা করেছে। খাসিয়া, গারো, সাঁওতাল, কোল ইত্যাদি উপজাতীয় ভাষার সঙ্গে মুন্ডা ভাষার সম্পর্ক লক্ষণীয়। অসংখ্য মুন্ডা শব্দ বাংলা ভাষায় বিশেষত আঞ্চলিক ভাষায় বিদ্যমান। কৃষি, গৃহস্থালি, বসতি, গণনা, আত্মীয়তা, ওজন, ভূমি, পশুপাখি, গাছ- গাছড়া ইত্যাদি সংক্রান্ত শব্দ মুন্ডা তথা অস্ট্রো-এশীয় ভাষা থেকে আগত।

মুন্ডা ভাষা ব্যাপক অঞ্চলজুড়ে চালু ছিল বলে এর আঞ্চলিক রূপও ছিল। দক্ষিণ বিহার ও উড়িষ্যার সংলগ্ন অঞ্চলে, মধ্য প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে প্রায় এক কোটি মুন্ডা ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশে এদের সংখ্যা প্রায় ১৫-২০ হাজার।

অনার্য মুন্ডা ভাষার সঙ্গে বাংলার ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব ও পদ ক্রমের ব্যাপক সাদৃশ রয়েছে ম-া ভাষায় শব্দ দ্বৈতের বাহুল্য আছে। স্ত্রী-পরুষ বাচক শব্দ বসিয়ে লিঙ্গান্তর করা হয়। মুন্ডা ও বাংলায় কারক বিভক্তির ব্যবহার অনেকটা অনুরূপ। মুন্ডা ও বাংলায় ১০ পর্যন্ত সংখ্যাগুলোর বুৎপত্তি এক। ‘হালি’ এবং ‘কুড়ি’ বাংলার মতো মুন্ডায়ও গণনার একক। 

সাঁওতালী ভাষা : 
সাঁওতালী ভাষা অস্ট্রো-এশীয় ভাষা গোষ্ঠীর প্রাচ্য শাখার অন্তর্ভুক্ত। প্রায় দশ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া হয়ে ব্রহ্মদেশ ও অসমের ভেতর দিয়ে অস্ট্রো-এশীয় জনগোষ্ঠী ভারত উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিহারে সাঁওতাল পরগনায় সাঁওতালভাষী জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি। পশ্চিমবঙ্গে বিহার সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এবং বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে দিনাজপুর, রাজশাহী ও রংপুরে বিক্ষিপ্তভাবে প্রায় দেড় লক্ষ সাঁওতাল ভাষী লোকের বাস আছে। তারা বাংলায় সাবলীলভাবে কথা বলতে পারে এবং নিজেদের ভাষায়ও বহু বাংলা শব্দ ব্যবহার করে। সাঁওতাল ভাষায় দুটি উপভাষা আছে ‘নাইলি’ ও ‘করকু’। এটি অনক্ষর ভাষা। ভারতে এখনও সাঁওতালী ভাষা দেব নগরী অক্ষরে লিখিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে কোন সাঁওতালী বই-পুস্তক নেই। খ্রীস্টান মিশনারিরা দু’-একটি সাঁওতাল বিদ্যালয় স্থাপন করে ইংরেজী বর্ণমালায় সাঁওতালী ভাষা শিক্ষা দিচ্ছে।

সাঁওতালী ভাষার প্রায় সব ধ্বনিই বাংলায় রয়েছে। বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্যান্য ব্যাকরণিক মিলও আছে। মূল সাঁওতালী ভাষায় শব্দান্তে প্রত্যয় যোগের কোন প্রক্রিয়া নেই। সাঁওতালীতে প্রাণী ও অপ্রাণী বাচক সর্বনাম ভিন্ন ভিন্ন। সাঁওতালী, কোল, মু-া ইত্যাদি ভাষা বাংলা থেকে তো বটেই ভারতীয় আর্য ভাষা থেকেও প্রাচীনতর। বাংলায় ও আঞ্চলিক উপভাষায় বহু সাঁওতালী শব্দ রূপান্তরিত অবস্থায় আজও বিদ্যমান।

কোচ ভাষা : 
কোচ ভাষা সাইনো-টিবেটান পরিবারের এই ভাষাটিতে প্রচুর বাংলা, উড়িয়া, হিন্দী, অহমিয়া ও ছোট নাগপুরী ভাষার মিশ্রণ ঘটেছে। কোচদের নিজস্ব ভাষা আছে, বর্ণমালা নেই। কোচ জনস্যংা এখন ছয় হাজারেরও বেশি কোচ ভাষার ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত। কেবল প্রাচীন লোকেরাই কোচ ভাষায় ভাব বিনিময়ে করতে পারে।

হাজং ভাষা : 
জমিদারদের বিরুদ্ধে টঙ্ক আন্দোলনখ্যাত হাজং পরিবারের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে এসেছে। বর্তমানে হাজংয়ের সংখ্যা বারো হাজারের মতো। হাজংদের নিজস্ব ভাষায় বর্তমানে বহু বাংলা শব্দ ঢুকে গেছে।\

খাড়িয়া ভাষা : 
বাংলাদেশে হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে প্রায় ৬ হাজার খাড়িয়া রয়েছে। অস্ট্রো-এশিয়াটিক পরিবারভুক্ত খাড়িয়া ভাষা রোমান হরফে লিখিত হতে থাকে পরবর্তীকালে বাংলা ও দেব নাগরী হরফে ও লেখা খাড়িয়া ভাষার চর্চা শুরু হয়। বাংলাদেশে কেবল প্রবীণ খাড়িয়ারাই তাদের মাতৃভাষা ব্যবহার করতে জানে।

তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা : 
তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী মোট বাংলাদেশে একান্ন হাজার পাঁচ শ’র কিছু বেশি। জার্মান ভাষা বিজ্ঞান গিয়ার্সনের সমীক্ষায় ১৯০৩ সালেই স্পষ্ট করে বলা হয় তঞ্চঙ্গ্যা একটি পৃথক ভাষা, যা ইঙ্গো ইউরোপীয় পরিবারভুক্ত। তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে এবং এ ভাষাটির সাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ।


উপজাতীয় ভাষাসমূহ অস্ট্রো-এশীয়, ইন্দোচীন, চীন-তিব্বতি, তিব্বতি-বর্মণ, ইঙ্গো-ইউরোপীয় ও দ্রাবিড়ীয় ভাষা পরিবারের কোন না কোনটির অন্তর্ভুক্ত। বাংলা ভাষা গঠনের যুগে উপজাতীয় ভাষাসমূহের অবদান অপরিহার্য।

কাজেই বলা যায় বাংলা ভাষা গঠনে বাঙালীর মূল পূর্বপুরুষ বঙ, কোল, ভীল, সাওতাল ও দাক্ষিনাত্যের তামিল জনগোষ্ঠী অর্থাৎ দ্রাবীড় জাতির অবদানও নিহিত আছে কারণ বহিরাগত আরয জাতির পূর্বে ভারতবর্ষ তাদেরই স্বদেশ ছিল। বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হলেও জেনেটিক বিশ্লেষণ বলছে অস্ট্রিক ভাষা পরিবার এবং দ্রাবিড় ভাষা পরিবারেও বাংলার শিকড় ছড়িয়ে আছে, বাংলা ভাষা বিশ্লেষণেও নতুন এই আবিষ্করকেই সমর্থণ করে। ভাষাতাত্ত্বিকরা এই বিষয়ে অদূর ভবিষ্যতে আরও নতুন দিক উন্মোচন করবেন এই প্রত্যাশা তাই করাই যায়।


------


দোহাই:

1 Vargha-Khadem et al., 2005, p. 131

2 Simon Fisher, a neurogeneticist at the Max Planck Institute for Psycholinguistics in Nijmegen, the Netherlands, and his colleagues

3 Richard Huganir, the neurobiologist at Johns Hopkins University School of Medicine in Baltimore, Maryland

4 Gene, Brains and Language: An Epistemological Examination of How Genes Can Underlie Human Cognitive Behavior, Nathalie Gontier, American Psychological Association, Vol-12, 170-180

৫ ভাষা, সংস্কৃতি ও মানবস্বত্তা: একটা নৃবৈজ্ঞানিক আলাপচারিতা – বখতিয়ার আহমেদ

৬ 6 Ruhlen, M. (1991) A Guide to the Languages of the World (Standord Univ. Press, Stanford, CA)

7 Kamrul Hasan , Vinnochokh Language Issue.

8 Cavalli-Sforza, L.L., Menozzi, P., Piazza, A. & Mountain, J.L. (1988) Proc. Natl. Acad.Sci.USA 85, 6002-6006

9 Gene, peoples and languages, L.Luca Cavalli-Sforza, Department of Genetics, School of Medicine, Standford University, CA

10 Nei and Roychoudhury (1993)

11 Gazi NN, Tamang R. Sing VK, Ferdous A, Pathak AK, et al. (2013), Genetic Structure of Tibeto-Burman Populations of Bangladesh: Evaluating the Gene Flow along the Sides of Bay-of-Bangal

12 A- Haplotype diversity of 17 Y-chromosomal STR loci in the Bangladeshi population

-Shafiul Alam , Md. Eunus Ali, Ahmad Ferdous , Tania Hossain , Md. Mahamud Hasan , Sharif Akhteruzzaman

https://www.researchgate.net/publication/41404398_Haplotype_diversity_of_17_Y-chromosomal_STR_loci_in_the_Bangladeshi_population: 

Haplotype and allele frequencies of 17 Y-chromosomal STR loci were determined in 216 unrelated Bangladeshi males. AmpFlSTR Y-filer PCR Amplification kit (Applied Biosystems) was used to type the following Y-STR markers: DYS19, DYS389I, DYS389II, DYS390, DYS391, DYS392, DYS393, DYS385a/b, DYS438, DYS439, DYS437, DYS448, DYS458, DYS456, DYS635, and Y-GATA-H4. A total of 211 haplotypes for the 17 Y-STR markers were detected and, of these, 206 haplotypes were unique. The haplotype diversity was 0.9998, indicating a high potential for differentiating between male individuals in this population. Comparison analysis via Analysis of Molecular Variance (AMOVA) and construction of Neighbor Joining Tree revealed a close association of Bangladeshi population with Indian Gaddi and Southern Indian populations.

For having extensive illustration of the genetic relation, minimal haplotypes of Bangladeshi population were compared via AMOVA with 860 Bhutanese individuals [9], 768 Nepalese Individuals [10], 123 Tamil individuals from Southern India [11], 53 Gaddi Individuals from Himachal Pradesh, India (YHRD, Accession # YA003412), 57 Gujar individuals from Himachal Pradesh, India (YHRD, Accession # YA003413), 108 Panjab Jat Sikh individuals from Panjab, India [12], 91 Haryana individuals from Haryana, India [13], 315 Indian Individuals from Malaysia [14], 335 Malay individuals from Malaysia [14], 334 Han Chinese Individual from Malaysia [14], 501 Thai individual from central Thailand (YHRD, Accession # YA003414), 41 Indonesian individuals (YHRD, Accession # YA002928), 575 Korean Individuals from South Korea [15], 66 Japanese individuals [16], and 125 Mongolian Individuals [17]. Comparative study revealed the close relationship of our population with Gaddi population from Himachal Pradesh, India (F st=0.0064, P= 0.7706) followed by Southern Indian (Tamil) population (F st=0.0003, P= 0.3920). Bangladeshi Population is significantly different from other reference population in spite of lower genetic distance with Malaysian Indian population (F st = 0.0309) as well as with Panjab Indian population (F st = 0.0309).The Neighbor Joining Tree (Fig.S1) structured from F st distance matrix shows that Bangladeshi population along with Indian Gaddi, Southern Indian, Malaysian Indian and Panjab Indian populations form a conspicuous cluster standing far apart from other asian population. Our population data have been submitted to the Y-STR Haplotype Reference Database (YHRD Accession # YA003445).This paper follows the guidelines for the publication of data requested by the journal [18].

B- Genetic diversity study on 12 X-STR loci of investigator® Argus X STR kit in Bangladeshi population

-Abu Sufian, Md. Ismail Hosen, Kaniz Fatema, Tania Hossain, Md. Mahamud Hasan, Ashish Kumar Mazumder & Sharif Akhteruzzaman 



The X-chromosome short tandem repeat (STR) lociare of particular interest for solving complex kinship and paternity cases. Here, we report the genetic data from 209 unrelated Bangladeshi individuals (102 males and 107 females) that were genotyped using the 12 X-chromosomal STR markers included in the Investigator® Argus X-12 kit (Qiagen). The 12 X-STR markers are located in four linkage groups (linkage group I: DXS10135, DXS10148, and DXS8378; linkage group II: DXS7132, DXS10079, and DXS10074; linkage group III: DXS10103, HPRTB, and DXS10101; and linkage group IV: DXS10146, DXS10134, and DXS7423). Allelic frequencies of the 12 X-STR loci and haplotype frequencies of the four linkage groups were investigated. No significant difference was observed in the allele frequencies of males and females. Distributions of heterozygosity were observed from 64.5 to 92.5% among the studied 12 X STR loci. DXS10135 and DXS10101 loci were found to be most polymorphic. For all the four linkage groups, the haplotype diversity was found to be greater than 0.986. A total of 95, 73, 66, and 74 haplotypes were observed in linkage groups I, II, III, and IV, respectively. Hardy–Weinberg equilibrium tests showed no significant deviation from expected values for all 12 loci (p > 0.05). The exact test for pairwise linkage disequilibrium for the 12 loci in the male samples did not show any significant linkage disequilibrium except the DXS10103 and DXS10101 loci after the p values were corrected by Bonferroni’s correction for multiple testing (p > 0.05/66). A combined power of discrimination in male and female individuals were 0.999999998159791 and 0.999999999999993, respectively. The combined mean exclusion chance were 0.999997635 in deficiency cases, 0.999999996 in normal trio cases, and 0.999999178 in duo cases. The currently investigated Bangladeshi population showed significant differences when compared with previously reported X-STR data from other 12 populations. The results of the data analysis indicated that all the loci in the Investigator® Argus X 12 kit were fairly informative and might be useful in forensic application and kinship analysis in Bangladeshi population

১৩ গাদ্দি উপজাতি ((Gaddi Tribes, The Gaddis, also called Gadderan ) :- মুসলিম সম্প্রদায়ের গাদারিয়ানরা মূলত পশুপালক এবং অত্যন্ত সৎ, শান্তি প্রিয়। এই উপজাতির মানুষেরা মূলত হিমাচল প্রদেশ, ভারতের উত্তরের রাজ্যসমূহে, যথা- উত্তর প্রদেশ, দিল্লী, বিহার ও রাজস্থানে এবং কিছু জম্মু ও কাশ্মীরে বসবাস করেন। এঁরা হিমাচল প্রদেশ এর মান্ডি, কাংড়া ও বিলাসপুর জেলায় বসবাস করেন। তবে সবচেয়ে বেশি বসবাস করেন কাংড়া জেলায়। নৃতত্ববিদদের মধ্যে এই উপজাতির উদ্ভব নিয়ে বিতর্ক আছে।

William Crooke describes them as a “community of cow-herders” in his Tribes and Castes of North-Western India (1896). They are said to have migrated from the hills of Himachal Pradesh and Jammu & Kashmir or possibly from the plains of the Punjab. The Gaddi of Bihar migrated from Uttar Pradesh along with the British soldiers when they were fighting the Muslim rulers in the 18th century.
Crooke, along with Denzil Ibbetson (1916), mentions them as a subgroup of the larger Ghosi Muslim community, and suggests that they are converts to Islam from the large Ahir community of shepherds who are spread throughout India. In fact, the Gaddi of the Hardoi district of Uttar Pradesh claim that they originally belonged to the Gwalbansi (milkman lineage) subgroup of the Ahir, and that they embraced the Muslim faith during the reign of Mughal Emperor Aurangzeb (1658-1707).

In Bihar, where they are also known as Goala (milkmen), they claim that they are the descendants of the first elderly learned person called Gaddi Salauddin Rahmatulla Alam. In Rajasthan, the Gaddi claim that their forefathers looked after Emperor Akbar’s throne or gaddi and were named the same.

This community has good relationships with other communities and also accepts food and water from them, both Hindu and Muslim. The exceptions are certain lower caste groups like the Chamar (tanner), Bhangi or Churha (sweepers and scavengers), and Lohar (ironsmith).




উর্দু গাদ্দিদের প্রধান ভাষা, কিন্তু হিন্দিও স্বচ্ছন্দে বলতে পারে। এরা রাজস্থানে উর্দু আর হিন্দির মিশ্রণে আর বিহারে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের একটা স্থানীয় ভাষা ‘সাদরি’ ভাষায় কথা বলে। উর্দু লেখার জন্য ফার্সী আরবী লিপি আর হিন্দি লেখার জন্য দেবানাগরী লিপি ব্যবহার করেন।


এই উপজাতির নারী পুরুষ উভয়েই রং বেরং এর পোষাক পড়তে ভালোবাসেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নৃত্য গীত এ তাঁরা পটু। তাঁরা বৈশাখী, লোহরী, পাত্রোরু, সাগরান্ড, শিবরাত্রি প্রভৃতি উৎসব পালন করে থাকেন।


১৪ অসীত দাস প্রণীত বই 'নামধামের উৎসকথা'-অভিযান পাবলিশার্স


১৫ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রখম খন্ড), প্রধান সম্পাদক: আনিসুজ্জামান, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৩


16 বাংলাদেশের বিভিন্ন উপজাতির ভাষা- মোঃ জোবায়ের আলী জুয়েল




1 comment: