অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়
বাবাই
বেশ কয়েক বছর আগের কথা । তবে সময় নির্ঘণ্ট হিসেব করে বলা কঠিন তা কত বছর আগের । সাল গণনায় আমি ভীষণই আনাড়ী । আমার জন্মের তারিখ আর বিয়ের তারিখে ঘোর বিপত্তি দেখা দেয় মাঝেমধ্যে । এই ব্যাপারে বৌয়ের কাছে টক-ঝাল-মিষ্টি অনেক খিস্তিও খেতে হয় । আমি জানি আপনাদের বিশ্বাস হবে না কথাটা । না হওয়াটাই স্বাভাবিক । এ যে আমার কথা । আমার জীবন কথা আপনারা জানবেন কিরে ? এই সংসারে প্রত্যেক ব্যক্তির জীবন কাহিনী যে আলাদা আলাদা ।
সে কথা এখন থাক । তবে এটুকু হলপ করে বলতে পারি যে, দিল্লীতে তখন প্রায় সব রুটেই প্রাইভেট মিনি বাসের খুব প্রচলন ছিল । ঝড়-জল-দুর্যোগের সময় অগতির গতি প্রাইভেট মিনি বাসের দেখা পাওয়া যেত খুব সহজেই । যেন জল না চাইতেই বৃষ্টি এসে হাজির । হাঁ করে বাসের অপেক্ষায় আর সময় গুণতে হতো না । যাত্রীদের উদ্ধার করার ব্যপারে সেকালে মিনি বাসের জুড়ি ছিল না ।
সেই রকম একটি বাসে চেপে কোন এক অখ্যাত দিনে জানালার পাশে কোন মতে এক কোনে নিজের বসার মতো একটু জায়গা করে নিয়ে বাইরের দৃশ্যাবলী দু’নয়ন ভরে উপভোগ করতে করতে আমি যাচ্ছিলাম মিশনে । ভীড় বাসে এবং তদুপরি জানালার পাশে বসতে পারার আনন্দটা বোধহয় লটারি পাওয়ার চেয়েও বেশি । এই অনুভূতির মাধ্যমেই বোঝা যায় জগতের প্রত্যেকটির মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকে একটি শিশুমন । বাস নিজ গতিতে এগিয়ে চলেছে, সম গতিতে দুলছি আমিও । পরন্ত বিকেলের ফুর ফুরে বাতাসের দাপটে আমার মনের কোনেও দোলা লেগেছিল । রবীন্দ্র সংগীত গাইছিলাম মনে মনে । এই রকম কোন একাকী মূহুর্তেই ঘটে কবিগুরুর সঙ্গে নিবিড় সাক্ষাৎ । তিনি আমাদের অনেক কিছু দিয়ে গিয়েছেন । পরিবর্তে তাঁকে আমরা কিছুই দিতে পারিনি । এমন কি তাঁর নিজের যোগ্যতায় অর্জিত নোবেল পুরস্কারটিও শেষ পর্যন্ত চুরি হয়ে গেল ! সত্যি কী বিচিত্র এই দেশ !
এমন সময় হঠাৎ এক স্নেহময়ী বঙ্গনারীর অসহায় কণ্ঠস্বরে আমার একগ্রতায় ছেদ পড়ে । ভয় বিজড়িত আর্তস্বর যাকে বলে । অনেক ব্যাকুল হয়ে কাউকে সম্বোধন করলে যেমনটি শোনায় – বাবাই, বা-বা-ই !
অথচ কিমাশ্চর্যম ভীড়ের মধ্যে যার উদ্দেশ্যে এই ডাক তাঁর দিক থেকে কোন প্রকার সাড়া শব্দ ছিল না । ভাবলাম তবে কি নাবালক বাবাই নামে ছেলেটি বাসে উঠতে পারেনি ? দিল্লী শহরে অবশ্য এরকম ঘটনা নতুন নয় । প্রায়ই ঘটে । এই শহরের বুকে মানবিকতা বলে কিছু নেই । ভীষণ রুক্ষ আর অন্তঃসারশূন্য কঠিন পাষাণ হৃদয় । এই শহরের উপযুক্ত ট্যুরিজম ট্যাগ লাইন হওয়া উচিৎ - ‘চাচা আপন বাঁচা’।
সত্যি বলতে কি আমি তখন রবীন্দ্রসংগীতের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম । ভাবছিলাম মহিলার এই বিপদে কোন উপকার বা সাহায্য করতে পারি কি না ? ভাববার একমাত্র কারণ এই যে বিদেশ বিভূঁয়ে বঙ্গনারীর আর্ত্ত চিৎকারে স্বয়ং বাঙালি হয়ে অন্যমনষ্কতার ভান করে মুখ ঘুরিয়ে থাকা খুব কঠিন কাজ । ছেলে হারানোর ব্যথায় মায়ের মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে যারপরনাই আমি বেশ উৎকণ্ঠিত বোধ করছিলাম । তারচেয়েও বড় কথা, আমি বাসে ওঠা অবধি কোন বাচ্চা ছেলেকে দেখিনি । ছেলেটি যে আদৌ উঠতে পারেনি মহিলা কি সকথা জানতেন না ? কি ধরণের মহিলা তিনি ? হাজার প্রশ্ন তাঁকে ঘিরে । ছেলেটি বাসে ওঠার আগেই স্বার্থপরের মতো তিনি নিজে আগে-ভাগে উঠে পড়লেন ? এ কেমন বেয়াক্কেল মহিলা ?
দিল্লী ক্যাণ্ট ছাড়িয়ে বাস তখন উর্দ্ধশ্বাসে বাপুধামের দিকে ছুটে চলেছে । তাঁর একটু দূরে দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর নির্মিত বিখ্যাত ভাস্কর্য -গান্ধীজীর ডান্ডি অভিযান । তাকিয়ে দেখার মতো সেই দৃশ্য । বাপুধাপ স্টপে বাস থামতেই মহিলা পুর্নবার ডেকে ওঠেন – বাবাই ! কোন সাড়া নেই ।
সাহায্যের হাতখানি বাড়াতে যাব কিনা ভাবছি এমন সময় দেখলাম মহিলা বিদ্ধস্ত সৈনিকের মতো বাস থেকে নেমে ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করলেন । কাঁধে একটি সাইড ব্যাগ ঝোলানো । পশ্চাতে মাঝ বয়সী এক ভদ্রলোক তাঁর হাতেও একটি ব্যাগ । মহিলা নামতেই কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা বাবাই-এর দিকে এগিয়ে দিলেন । ভদ্রলোকটি মাথার অবিন্যস্ত কেশ রাশিকে এক হাতে পাট করার অবসরে যা বলেছিলেন তা কানে এল – ওরকম বাবাই বাবাই করে চিৎকার করছিলে কেন ? লোকে কি ভাবছিল বলো তো? ভাবছিল নিতান্তই অশিক্ষিত । আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম নাকি? ভদ্রলোকটির বয়স প্রায় চল্লিশের ঘরে । সেই অনুপাতে মহিলাটি প্রায় পয়ত্রিশ-ছত্রিশ । এরপর দু’জনেই পাশাপাশি হাঁটতে থাকেন ।
অবশেষে নিজের অজান্তে অন্তরের অন্তস্তল থেকে একটি দীঘশ্বাস বেরিয়ে আসে । এতক্ষণ যাবৎ আমি মনে মনে যা ভাবছিলাম এবার সেই কথাগুলো রোমন্থন করে অপার কৌতূক বোধ করছিলাম । সত্যি নামের কী বাহার ! মায়ের কাছেও বাবাই, বৌয়ের কাছেও বাবাই নামে খ্যাত । বোধ করি এই জীবনে বাবাই আর কোনদিনও বড় হতে পারবে না ।
Social Media Comment