DEHLIJ

আশরাফ জুয়েল

ঘন বাতাসের সুলেখা


‘নারী একবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লে পরবর্তীকালে ফিরে এলেও বস্তুত সে আর কখনোই ঘরে ফেরে না।’ লাইনটা খসখস করে লিখে প্রায় ঘণ্টা তিনেক খাতার দিকে তাকিয়ে উবু হয়ে বসে আছেন মামুল হাসান। এর ভেতর অনেক কিছুই ঘটে গেছে—একটা অত্যুৎসাহী তেলাপোকা তিনবার চেটে গেছে তার ডান পায়ের কড়ে আঙুল, সাতটা সিগারেট আত্মাহুতি দিয়েছে, লো-ব্যাক পেইনটা আস্কারা পেয়ে ডান পায়ের হাঁটু পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে, কমপক্ষে সাতটা কল মিসড হয়েছে। এসবে কিছু যায় আসে না—যা ঘটে গেছে, তা নিয়ে একজন লেখকের ভাবার কিছু থাকে না বা থাকতে নেই, যা ঘটবে তা নিয়েই তার সব ভাবনা আবর্তিত হওয়া উচিত।


চাকরিজীবী মামুল আর্থিক দিক বিবেচনায় ইতোমধ্যে স্বাবলম্বী। তবে লেখক হিসেবে সে নিজেকে নিঃস্ব ভাবে। মামুল তার ভাবনাগুলোকে অক্ষরবন্দি করার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে সারাক্ষণ—কখনও পারে, কখনও পারে না। এই পারা না পারার মধ্যে তার দুই সত্তা হাবুডুবু খায়। আজ এই মুহূর্তে যা হচ্ছে, এমনটা সাধারণত হয় না— শেষ লাইনটা লিখে আর কিছুতেই সামনে এগোতে পারছে না সে। বর্ষার কাঁচামাটির গর্ভবতী চুলোর মতো অবস্থা যেন— খড়ি, কেরোসিন, দিয়াশলাই সবই আছে কিন্তু কিছুতেই আগুন জ্বলছে না। উপন্যাসটা শেষ করা জরুরি। নতুন খুশকির মতো জ্বালাতন করছে ভাবনাটা। 


অবশ্য এই তিন ঘণ্টার মধ্যে শুধু আরও অনেক কিছুই না, আসলেও অনেক কিছুই ঘটে গেছে। হ্যাঁ, মামুল মানছে, সে বাসায় প্রায়শই ড্রিংক করে, লেখক বন্ধুরা আসে, রাতভর আড্ডা হয়—তবে সেটা খুবই কম, মাসে বা দুইমাসে একবার। এছাড়া, তার বেশকিছু মেয়েবন্ধু আছে। এ কথা স্বীকার করতে মামুলের দ্বিধা নেই, তাদের সঙ্গে বহুবার শুয়েছে। সেটা নিছকই শরীরের সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক— ছুঁয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই নয়।


এমনও হয়— একটা উপন্যাসের শেষটা ভাবতে না পেরে ভেতরে ভেতরে খুবই অস্থির হয়ে ওঠে, কিছুতেই চরিত্রগুলোর সঙ্গে পেরে ওঠে না সে। নচ্ছার চরিত্রগুলো ঘুম কেড়ে নেয় মামুলের। রাতের পর রাত এমন ঘটতেই থাকে। নির্ঘুম মামুল ক্রমশ আরও অস্থির হয়ে ওঠে। তখন দেখা যায়, কোনও এক বান্ধবীকে ডেকে নেয় মামুল—উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে সরিয়ে রাখে শরীরের উষ্ণতা থেকে, নারীর কাদার মাঝে দ্রবীভূত হয়ে যায় মামুল, এমন সংকট-মুহূর্তে মামুল অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে ওঠে—মেয়েবন্ধু নিজের মতো করে সুখ নিতে থাকে, মামুল ঘুরে বেড়ায় উপন্যাসের অমীমাংসিত চরিত্রদের হাত ধরে। একসময় ঝড় থামে। হয়তো তার বন্ধু বুঝতেই পারে না—মামুল আর মামুলের ভেতর নেই, অবশ্য এটা মামুল ছাড়া আর কেউই বোঝে না। বোঝার প্রয়োজনও হয় না। যার যা চাহিদা, তা পূরণ হয়ে গেলে কিছু না বুঝলেও চলে। হয়তো হঠাৎ কথা বলে উঠে অসমাপ্ত উপন্যাসের সমাপ্তি, মামুল দ্রুত ঘরে ফিরে আসে। লিখতে বসে, তরতর করে এগিয়ে যেতে থাকে উপন্যাস।  এমনও হয়েছে সেই বান্ধবী হয়তো ফোন করে মামুলকে আবার ডাকছে, এরমধ্যে মামুল হয়তো ভুলেই গেছে, সে কবে সেই বন্ধুর সঙ্গে কোথায় শুয়েছিল।


মামুলের স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, তিন বছরের সন্তানকেও সঙ্গে নিয়েছে। অভিযোগ গুরুতর। মামুল যে মেয়েবন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করে, এ বিষয়ে তার স্ত্রী ঘুণাক্ষরেও জানে না। জানার কোনো সুযোগ তাকে দেয়নি মামুল। মামুল কখনোই বাসায় কোনো মেয়েবন্ধুকে ডাকে না। হয়তো কখনও সে নিজেই মেয়েবন্ধুর বাসায় যায় বা হারেশের ফ্ল্যাটে ডেকে নেয়।  


হারেশ তার বন্ধু, থাকে নিউজার্সিতে, বছরে একবার আসে, কখনও দুইবছর পরপর। গুলশানের সেই রেডি ফ্ল্যাটের চাবি মামুলের কাছেই থাকে, তবে মামুলও একেবারেই অনিয়মিত এই ফ্ল্যাটে। গত ছয়মাসে মাত্র একবার আসতে হয়েছিল—নীলিমার সঙ্গে। নীলিমা তার সুন্দরী বন্ধু, ধনকুবেরের স্ত্রী—এটা অবশ্য তার আসল নাম নয়। নীলিমার বাসা বারিধারা। সে প্রতিদিন বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে আসে, একেবারে স্কুল শেষ করে বাসায় ফেরে। বাসায় ফিরবে কেন? বাসায় ফিরে কিছু পায় না সে। মামুলকে প্রায় আসতে বলে, মামুল আসে না। আসে, যখন তার কোনো গল্প বা উপন্যাসের কোনো চরিত্র তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, তখনই। আসে, এসে আবার আসার কথা ভুলেও যায়। নীলিমা অবশ্য তাতেই খুশি। মামুল এই সময়ের নামকরা লেখক। লেখকদের প্রতি মেয়েদের বিশেষ দুর্বলতা আছে। যেমন ছিল দীপ্তির, তার স্ত্রী।


কিন্তু দীপ্তি কি সবকিছু জেনে ফেলেছে? দীপ্তি আজ চলে গেছে, সম্ভবত বাপের বাড়ি। গত তিন ঘণ্টা ধরে লেখার টেবিলেই বসে আছে মামুল। আজ অফিস যাবে না। সারাক্ষণ বসে থাকবে লেখার টেবিলেই—সে দেখে নিতে চায় কতক্ষণ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আক্কাস তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে পারে।


সুলেখা ছাড়া বাসায় এইমুহূর্তে অন্য কেউ নেই। মামুল বসেই আছে, লেখার টেবিল ছেড়ে উঠবে না—এই সিদ্ধান্তে স্থির। মাঝে সুলেখা এসে চা দিয়ে গেছে তিনবার। মাঝে একবার দীপ্তিকে ফিরিয়ে আনার কথা বলেছে। মামুল হ্যাঁ, না কিছু উত্তর দেয়নি। কিছুক্ষণ পর আবার এসে বাবাইকে ফিরিয়ে আনার কথা বলেছে। মামুল মনে মনে ভাবছে, সুলেখা কি চাকরি ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাবে? মামুল নিজেকে জিজ্ঞেস করেছে। উত্তর পায়নি, উত্তর পায়নি বলেই একবার ডেকে জিজ্ঞেস করেছে, সে চলে যাবে না কি? উত্তরে সুলেখা হ্যাঁ-না কিছুই বলেনি। হয় যাবে, তাকে ‘না’ বলা পর্যন্ত হয়তো যাবে না। আবারও জিজ্ঞেস করলে সুলেখা জানায়, কাজ এ বাসার কাজ ছেড়ে দিতে পারে, কিন্তু অন্য কোথাও কাজ খুঁজে নেবে, সে এ কথাও জানায়—‘হামারেক কামের অভাব হোবি না।’


কথা বাড়ায় না মামুল। কথা বাড়ায় না সুলেখা। মামুল মন দেয় লেখায়। সুলেখা এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে। মামুলের কলম চলতে আরম্ভ করে। সুলেখা মন দিয়ে চা বানায়। সর্বশেষ লেখা পাতাটাকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দেয়। সুলেখা আবার একমগ চা বানিয়ে নিয়ে আসে। সুলেখার হাত থেকে চায়ের মগটা নেয় মামুল। সুলেখা মামুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। মামুল চায়ের কাপে চুমুক আঁকে। সুলেখা তাকিয়েই থাকে মামুলের দিকে। মামুল পরের লাইনটা ভাবতে থাকে। সুলেখা আবার রান্নাঘরে ফিরে যায়। এই মুহূর্তে মনে আসা বাক্যটা দ্রুত লিখে ফেলে মামুল। সুলেখা রান্নাঘর থেকে আবার মামুলের সামনে আসে। মামুল আবার তার লেখার খেই হারিয়ে ফেলে। সুলেখা তার বিস্রস্ত বুকের আঁচল ঠিক করে। মামুল সুলেখার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবে!


অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে মামুল। আজ হয়তো লেখাটা এগুবে না আর। আদৌ কোনোদিন এগুবে কি না, তাও জানে না মামুল। মামুল সুলেখার কথা ভাবে। বয়স আর কত হবে? তেত্রিশ বা চৌত্রিশ। আসলে সুলেখার বয়স আরও কম, বড়জোর পঁচিশ বা ছাব্বিশ! নারী, দরিদ্র হলে তাদের বয়সে বয়সের ছাপ নেমে আসে দ্রুত। খুব দ্রুত—যেন শীতের বিকেলে ঝুপ করে নেমে আসা সন্ধ্যার মতো। সুলেখা সবসময় একটা মুখোশ পরে থাকে। মুখোশের নাম—অপরিষ্কার। এই মুখোশের আড়ালে সে সযত্নে তার চেহারা লুকিয়ে রেখেছে। হয়তো ইচ্ছে করেই। আবার এমনও হতে পারে সে তার সুশ্রী চেহারার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল নয়, তবে এটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। নারী, হোক সে দরিদ্র কিংবা ধনী—সুন্দরী হলে সে তার সৌন্দর্যের ব্যাপারে শতভাগ সচেতন। ইদানীং সুলেখার কথা একটু বেশিই ভাবছে মামুল। আড়ালে আবডালে বেতনের বাইরেও সুলেখাকে কিছু অতিরিক্ত টাকা দেয় সে। প্রথম প্রথম সুলেখা নিতে অস্বীকৃতি জানালেও এখন নেয়, মামুলের চাপাচাপির কাছে সে নত হয়নি, বরং নত হয়েছে টাকার কাছে।


যাওয়ার আগে, ঝগড়ারও আগে, আজ ভোরে সুলেখাকে এলোপাথাড়ি থাপ্পড় মেরেছে দীপ্তি। ঝগড়াও তাকে নিয়েই। গলা উঁচিয়ে চিৎকার করে খুব বিশ্রী কিছু কথা বলছিল দীপ্তি। দীপ্তির চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় বাবাইয়ের, চোখ পিটপিট করে তাকাতে থাকে মামুল ও দীপ্তির দিকে। সুলেখা এসে বাবাইকে নিয়ে যায় ড্রইং রুমে। টিভি ছেড়ে জোরে সাউন্ড দেয়, কার্টুন চলে, আর ও ঘরে চলে ঝগড়া। 


—ছিঃ ছিঃ এত নোংরা তুমি?

চুপ থাকে মামুল।

—ভাবতেও পারি না, ছিঃ।

চুপ থাকে মামুল।

—লেখকদের চরিত্র নিয়ে মানুষ এমনিতে কি এত বিশ্রী বিশ্রী কথা বলে?

চুপ থাকে মামুল।

—এত জঘন্য তোমার মানসিকতা?

চুপ থাকে মামুল।

—বাচ্চাটার কথাও একবার মনে পড়লো না তোমার?

চুপ থাকে মামুল।

—তুমি আমার সাথে এমন করতে পারলে, তুমি তুমি একটা চরিত্রহীন।

চুপ থাকে মামুল।

—কী এখন চুপ করে আছ যে?

চুপ থাকে মামুল।

—তুই তো একটা শুয়োরের বাচ্চা।

চুপ থাকে মামুল।

—মানুষরূপী জানোয়ার তুই।

চুপ থাকে মামুল।

—এই জন্যই তো বলি ইদানীং কাজের মেয়ের জন্য তোর দরদ এত উথলে ওঠে কেন?

চুপ থাকে মামুল।

—রাত তিনটার দিকে কাজের মেয়ের ঘর থেকে বের হোস।

চুপ থাকে মামুল।

—শেষ পর্যন্ত কাজের মেয়ের সাথে শুতে হলো তোকে, কুত্তার বাচ্চা।

চুপ থাকে মামুল।

—তোর জন্য কাজের মেয়েই ঠিক আছে।

চুপ থাকে মামুল।

—চলে যাচ্ছি আমি, এখন এই মাগীকে রোজ রোজ চাটিস।

এখনও চুপ থাকে মামুল। দীপ্তি কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে গালি দিচ্ছে মামুলকে। মামুল চুপ করে থাকে। কিছু বলে না। কিছুই বলার নেই তার। দীপ্তি একটা ক্যারি-লাগেজে তার প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় গুছিয়ে নেয়। গয়না-পাতি নিতে ভোলে না। বাচ্চা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। 


আটকানোর চেষ্টা করে না মামুল। এখন নিজের সঙ্গে কথা বলার সময় তার। হ্যাঁ, সে সুলেখার রুমে গেছে। হয়তো বের হয়ে আসার সময় দীপ্তি তাকে দেখেছে। দেখেছে বলেই এমন উত্তেজিত হয়েছে। ঝগড়াঝাটি করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। কিন্তু সুলেখা কেন বারবার দীপ্তিকে ফিরিয়ে আনার কথা বলছে? দীপ্তি এলে বাবাই আসবে বলে? আসলে বাবাই দীপ্তিকে মা বলে ডাকে। দীপ্তিকে ডাকে মাম্মাম বলে। দিনের প্রায় পুরোটা সময় সে সুলেখার সঙ্গেই থাকে, রাতে ঘুমের সময়টুকু ছাড়া বাবাইয়ের সব কাজে সে সুলেখাকে পায়। বাবাই যে সুলেখাকে মা ডাকে, তাতে বিন্দুমাত্র আপত্তি তোলেনি দীপ্তি। দীপ্তি সারাদিন অফিস করে বাসায় ফেরে, ফিরতে ফিরতে তাও রাত সাড়ে সাতটা। এরপর কিছুসময় বাবাইয়ের সঙ্গে কাটিয়ে নিজের যত্ন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এই তো জীবন। না কোনো খাদ নেই, নেই কোনো খেদ।


সাধারণত রাত একটা দেড়টা পর্যন্ত জেগে থাকে মামুল। গত রাতে সাড়ে তিনটার দিকে ঘুম ভেঙে যায় মামুলের, ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি বের করে খাওয়ার জন্য ডাইনিং রুমে যায় মামুল। সুলেখার ফিসফিস শব্দে চুপিসারে এগিয়ে যায় সারভেন্ট রুমের দিকে।


—দেখি বাপজান, হা করো হা করো।

—এই হাফিজা তুই নেজের কী আবস্থা করি তুছিস। আয় তোর চুলগুলা আছরি দ্যাও। নে চিরুনি নে।

—কি রে মাসুদ, আব্বাজান বেগটা নাও, স্কুলে যায়া ভালো করি মনোযোগ দিয়া পড়ালেখা করবা।

—তোমাক নিয়া আর পারো না, কী করি থুইছেন শরীরটা।

—চঞ্চল তোমরাও হা করো বাপজান। হাফিজা তুইও নে, হা কর। আইজ গরুর গোস্ত দিয়া ভাত আন্না করছি। প্যাট ভরে খা।

—ভালো করি পরীক্ষা দেমেন আম্মাজান। মন দিয়া পড়ালেখা করবেন। স্কুল শ্যাষ করি সোজা বাড়িত আসমেন।

—কী কোলি? তোর নোতুন জামা লাগবি? দেমনে। 

—মাসুদ, আব্বা তোমার লাইগা কিচু লিয়া আসোম নানে? 

—হচে, লে থ, স্কুলত যা ত। 


পাঁচ ফিট বাই সাড়ে চার ফিটের জানালাহীন ঘরের ঘন বাতাসেই সুলেখা এঁকে নিয়েছে তার তিন সন্তানকে। মামুল বোঝে, সন্তান কাছে না থাকা মা এবং একজন লেখকের মধ্যে তেমন কোনও পার্থক্য নেই। 


No comments