DEHLIJ

রীতা বিশ্বাস পান্ডে

উইলিয়াম এলিয়ট গ্রিফিসের গল্প  'ক্যাট এবং ক্র্যাডল' এর অবলম্বনে

অনুবাদ করেছেন- রীতা বিশ্বাস  পান্ডে 





বিড়াল এবং দোলনা

প্রথম যুগে, যখন আমাদের মানে এই ডাচদের সুদূর পূর্বপুরুষেরা অরণ্যে বাস করতেন, আকর্ণ খেতেন, গুহায় ঘুমাতেন, এবং বন্য প্রাণীদের চামড়ার পোশাক পড়তেন তখন তাদের কোনও ঘোড়া, গরু বা বিড়াল ছিল না। তাদের পোষা প্রাণী এবং সাহায্যকারীরা ছিল কুকুর। মানুষ ও কুকুর এখনকার মতো একে অপরের বন্ধু ছিল।

 

তবে একটি কথা অস্বীকার করা যায় না সেটা হচ্ছে তারা মৌমাছি সম্পর্কে জানত। তাই জীবিকা নির্বাহ করতে মহিলারা মধু সংগ্রহ করতেন এবং মধু থেকে তারা খাবার তৈরি করতেন। কোনও চিনি না থাকায় বাচ্চারা অন্য যে কোনও কিছুর চেয়ে মধু স্বেচ্ছায় আহার করত এবং এটিই ছিল তাদের একমাত্র মিষ্টি খাদ্য। 

 

সৃষ্টির অনেক পরে পর্যটকদের দ্বারা গরু ডাচ দেশে আনা হয়েছিল এবং ডাচ মাটি ঘাসের জন্য ভাল ছিল বলে গরুদের জন্য প্রচুর পরিমাণে খাবার এই ভূমিতে ছিল। যখন এই প্রাণীগুলির বংশের বৃদ্ধি পেল  তখন লোকেরা দুধ পান করতে এবং পনির এবং মাখন তৈরি করতে শিখে নিল। তাই ডাচ ছেলে-মেয়েরা অচিরেই মোটা এবং স্বাস্থ্যকর হয়ে উঠল।

 

তাদের বলদগুলি এত শক্তিশালী ছিল যে তারা কাঠের মোটা মোটা লগ টানতে বা লাঙ্গল অনায়াসেই চালাতে পারতো। তাই, অল্প অল্প করেই, বনগুলি কেটে ফেলা হল এবং উজ্জ্বল বর্ণের ফুল ও পূর্ণ ঘাসের  মাঠগুলি তাদের জায়গা করে নিল। ক্রমশঃ তারা ঘর বানালো থাকার জন্যে এবং লোকেরা ধনী ও  সুখী হয়ে উঠলো। 

  

তবুও দেশে অনেক নিষ্ঠুর পুরুষ এবং দুষ্ট লোক ছিল। কখনো কখনো, বন্যা এসে গবাদি পশুগুলিকে নিমজ্জিত করে এবং ক্ষেতগুলি বালু বা নুনের জলে ভাসিয়ে দিয়ে যেতো। এই সময়ে, পরিস্থিতি খুব খারাপ হওয়ার দরুন খাবারের খুব অভাব দেখা দিতো। সুতরাং পরিস্থিতি এই হল যে পুষ্টির অভাবে  জন্মগ্রহণকারী সমস্ত বাচ্চাকে জীবিত রাখা যেত না বা প্রতিটি ছোট শিশুকে খাওয়ানো ও যেত না। এই  কারনে বিশেষত মেয়ে বাচ্চাদের প্রায়শই মেরে ফেলা হত। কারণ এক দলের সাথে অন্য দলের যুদ্ধ লেগেই থাকতো খাবারের মালিকানা আদায় করার জন্যে এবং তার জন্য একমাত্র ছেলেরা পারতো শক্তিশালী যোদ্ধায় পরিণত হতে, কাজেই ছেলে শিশুদের দরকার ছিল। 

  

নবজাত মেয়ে শিশুদের মেরে ফেলা একটি প্রথা হয়ে উঠেছিল তাই পরিবারগুলি একটি পরিষদ গঠন করার সিদ্ধান্ত নিল। এই পরিষদ সিদ্ধান্ত নেবে যে বাচ্চা বড় করা উচিৎ কিনা নাকি মেরে ফেলা উচিৎ। পরিষদ   বলে যদি কেউ শিশুকে খাবার দেয় এমনকি একটি ছোট ফোঁটা দুধ বা কোনও ধরণের খাবার দেয় তবে এটিকে বাঁচতে ও বড় হতে দেওয়া হবে। কেউ শিশুটিকে দুধ বা মধু না দিলে সেই শিশুটিকে মেরে ফেলা হবে।কোনও মা তার বাচ্চাকে কতটা ভালোবাসতে পারে তা বিবেচনা করতো না কেউ কাজেই একফোঁটা দুধ দেবার অধিকার মায়ের থাকতো না যদি পরিষদ মানা করে দিত।  ঠাকুরমা বা বড়রা যদি শিশুকে খাওয়াতে নিষেধ করে তবে তার ঠোঁটে দুধ রাখার অনুমতি ছিল না। 

 

এইসময়ে একটি অল্প বয়সী কনে তার স্বামীর বাড়িতে আসার পর সর্বদা তাকে তার স্বামীর মার আদেশ মেনে চলতে হতো।  কারণ তিনি এখন একটি বউ এবং পরিবারের একজন সদস্য। সকলেই এক বাড়িতে একসাথে  থাকতেন একই ছাঁদের নীচে ।  সেই পরিবারের ঠাকুর্মা সমস্ত মহিলা ও মেয়েদের শাসন করতেন।

এটি সেই সময়ের কথা যখন ডাচদের পূর্বপুরুষরা পৌত্তলিক ছিলেন এবং আমাদের মা ও বাবার যেমন আমাদের প্রতি সদা ভালবাসা বর্ষন করেন তেমনি তখন ছোট বাচ্চাদের প্রতি তার মা বাবারা সর্বদা  সদয় হতেন না। অনেক সময় বৃদ্ধ বৃদ্ধা রাগান্বিত হতেন যদি পুত্রবঁধু  পুত্র সন্তান জন্ম না দিত। যদি বুড়ো শাশুড়ির পুত্রসন্তানের প্রত্যাশা হতো যারা বড় হয়ে তরবারি এবং বর্শা অনুশীলন করে একটি  যোদ্ধা হতে পারে এবং সেই ক্ষেত্রে যদি একটি মেয়ে জন্ম নেয় তবে সেই শাশুড়ী আগুনের মতো পাগল  হয়ে উঠতেন।  

এমতাবস্থায় এরকম সেই পরিবারের সদ্য বিবাহিত এক পুত্র  গুরুজনদের আদেশ অবজ্ঞা করে তার স্ত্রীকে    নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিল কারন তাদের একটি মেয়ে সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল। কারন সুন্দর কনে ঘরে  আনলে পর সেই কনে তার স্বামীর সাথে সময় না কাটিয়ে স্বামীর মায়ের সাথে খুব কঠিন সময় কাটাতো তাই সেই পুত্রের খুব কষ্ট হত এবং সে আলাদা হয়ে গিয়েছিল।  

 

যে সময়কার কথা সেই সময় মিশনারীরা ফ্রিজল্যান্ডে এসেছিল এবং গস্পেল  গ্রহণের জন্য সব পরিবারকে আহবান করেছিল। প্রথম গস্পেল গ্রহনের একজন ছিলেন গৃহত্যাগী আল্টফ্রিড। আল্টফ্রিড তাঁর স্ত্রীর সাথে যে কিনা পরিবারের সাথে ঝগড়া করে বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিলন  তিনি  ও তাঁর স্ত্রী খ্রিস্টান হয়েছিলেন। আল্টফ্রিড মিশনারিদের গির্জা তৈরিতে সহায়তা করেছিলেন। কাছাকাছি সময়ে, পরিবারে একটি মিষ্টি ছোট্ট সন্তানের  জন্ম হওয়াতে আলফ্রিড ও তাঁর স্ত্রী খুব খুশি হন। তারা ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রেরিত ছোট্ট জিনিসটিকে  ইচ্ছাকৃতভাবে আপন করে নিলেন  কারণ তাঁর পিতামাতারা এখনও তাদের পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া সন্তানদের ভালবাসেন কিনা তিনি জানতেন না।  

কিন্তু কেউ যখন পৌত্তলিক ধর্মে বিশ্বাস করা বৃদ্ধা ঠাকুমাকে বলে দেয় যে, নতুন বাচ্চা ছেলের পরিবর্তে   একটি মেয়ে হয়েছে তখন বৃদ্ধা ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। ক্রাচে ভর দিয়ে দিয়ে তিনি ছেলের বাড়ি গেলেন। ছেলের বাড়িতে  গিয়ে তিনি লুকিয়ে তার ক্রাচ দিয়ে একবারেই বাচ্চাটিকে মেরে ফেলতে  চাইলেন।তার  এই ধরনের ক্রোধের জন্য ধীরে ধীরে তার পা খারাপ হয়ে গিয়েছিল তাই তিনি  একটি ক্রাচ নিয়ে চলাফেরা করতন। বাচ্চা মেয়ের ধাত্রী এটা জানতে পেরে ক্রাচটি লুকিয়ে ফেলে।  ধাত্রী, যিনি প্রতিবেশী ছিলেন, আশঙ্কা করেছিলেন যে বৃদ্ধ মহিলাটি শিশুকে মেরে ফেলবে তাই তিনি তার ক্রাচ লুকিয়ে রেখেছিলেন।  বাচ্চাকে  মারতে  গিয়ে ঠাকুর্মা তার ক্রাচ খুঁজে পান না । ধাত্রী ঠাকুমার খারাপ মেজাজ জানতেন বলেই  উদ্দেশ্যমূলকভাবে এটি লুকিয়ে রেখেছিলেন। বৃদ্ধা ঠাকুমা রাগ করেছিলেন  কারণ তিনি এতো বড় পরিবারে আর কোনও মেয়ে সন্তান চাইতেন না।   

আগেই খুব বেশি খাওয়া তিনি পরিবারের সবার মুখে তুলে ধরতে সক্ষম ছিলেন না  কারন আগেই বলেছি এলাকাতে খাদ্য পাওয়া খুব কঠিন ছিল, এবং উপজাতিটিকে রক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত যুদ্ধের লোক ছিল না। তাই সবাই ছেলে সন্তান চাইতো। এরপর  তিনি নতুন বাচ্চাটিকে নেকড়ের মুখে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ধাত্রীর সময়োপযোগী পদক্ষেপে এটাতেও তিনি বিফল হন।  

এদিকে আবার বৃদ্ধ ঠাকুর্মা একজন পৌত্তলিক  ছিলেন এবং এখনও দেবতাদের উপাসনা করছিলেন যা যুদ্ধ পছন্দ করে। তিনি নতুন খ্রিস্টান ধর্মকে ঘৃণা করতেন কারণ এটি নম্রতা এবং শান্তি শিখিয়েছিল।

ধাত্রী একজন ভাল মহিলা ছিলেন, যিনি শিখেছিলেন যে মহান স্রষ্টা ছোট মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদেরও ভালবাসেন।

তাই ধাত্রী যখন ঠাকুমার কান্না ও হাহাকার শুনতে পেয়েছিল, তখন তার ক্রাচ লুকিয়ে পাচার করার সময়, তিনি প্রথমে মধুর জারের কাছে ছুটে গেলেন, তারপর মধুতে তর্জনী ডুবিয়ে কন্যা শিশুর জিহ্বায় কিছু ফোঁটা মধু লাগিয়ে দিলেন যাতে সদ্যজাত মেয়ে সন্তানটি মধু চ্যাঁটে খেতে পারে।  তারপরে সে কিছু মহিলা বন্ধুর কাছে বাচ্চাটিকে জানালা গলিয়ে দিয়ে  দিয়েছিলেন, যারা বাইরে বাচ্চাটির অপেক্ষা  করছিলেন।  ধাত্রী সেই আইনটি জানতেন, যেখানে নির্ধারিত হয়েছিল যে, কোনও শিশু যদি খাবারের স্বাদ  গ্রহণ করে তবে অবশ্যই শিশুটিকে বাঁচাতে দেওয়া হবে। 

দয়ালু মহিলারা বাচ্চাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যান এবং যত্ন সহকারে খাওয়ান। একটি গরুর শিংয়ের ছোট প্রান্তে একটি গর্ত করে দেওয়া হয়েছিল এবং গাভীর থেকে সতেজ উষ্ণ দুধটি শিঙের মধ্যে নিয়ে  ড্রপ করে করে শিশুটিকে পান করতে দেওয়া হয়েছিল। কিছু দিনের মধ্যে ছোট শিশুটি তার খাদ্য আস্তে আস্তে শিং থেকে  চুষতে শিখে গিয়েছিল। শিংের অন্যদিকে একটি মেয়ে ধরে থাকত। তাই শিশুটি প্রতিদিন বড় হতে থাকে।    শিশুটিকে সাবধানে তাদের বাড়িতে কাপড়ের বোঁচকার মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

বোকা বৃদ্ধ বৃদ্ধা দুজনকেই ভুল খবর দেওয়া হয়েছিল যে বাচ্চাটি মারা গেছে। কারণ তাঁরা কখনই  জানতে পারেননি যে বাচ্চা মেয়েটি কোথায় ছিল। এদিকে বাচ্চাটি  শক্তিশালী দুধ আর মধু পান করে কাপড়ের বোঁচকার মধ্যে বেড়ে চলেছিল। তার বাবা তাকে গোপনে একটি দোলনা বানিয়ে দিয়েছিলেন।  তিনি এবং বাচ্চাটির মা প্রায়শই তাদের সন্তানকে দেখতে আসতেন। প্রত্যেকেই তাকে হানিগ-জে  বা ছোট মধু বলে ডাকতো।  

ঐ সময় দেশে বিড়াল ছিল না। কিন্তু বাচ্চাটির জন্মের পর পরই  বিড়ালদের দেশে আনা হয়েছিল এবং সকল বাচ্চাদের মধ্যে এমন পোষা প্রাণী আদরের হয়ে ওঠার জন্যে কয়েকটি গরুর মনে ভয় হয় এবং মানুষদের বিড়ালের প্রতি বেশি মনোযোগের জন্য ঈর্ষা তৈরি হয়। এই দিনগুলি এমন ছিল যখন গরু এবং লোকেরা সকলেই একটি দীর্ঘ ছাদের নিচে বাস করত। বিড়ালের চোখ দেখে বাচ্চারা বলে দিত এটা দিন না  সকাল।  হোক দুপুর হোক বা  রাত বিড়ালের বিড়ালের চোখ দেখে বুঝতে পারতো। বাচ্চারা সব সময় বিড়ালের সাথে খেলায় মত্ত থাকতো। 

হ্যানিগ-জে-র বাড়িতে  মোটা বিড়াল আনা হয়েছিল আর মনে হয়েছিল ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটির তা খুব পছন্দ হয়েছিল এবং বিড়াল ও বাচ্চা মেয়েটি দু'জনে একসাথে খেলতো সবসময়। এটি প্রায়শই বলা হত  যে বিড়াল তার নিজের বিড়ালছানাগুলির চেয়েও হানিগ -জেকে বেশী পছন্দ করে। সবাই এই স্নেহময় প্রাণীটিকে ডাব-বেল্ট-জে বলে ডাকতো, যার মানে হচ্ছে ছোট্ট ডাবল।  কারণ বেশিরভাগ  বিড়াল মায়েদের  কাছে এই দুই শিশু  নিজের বাচ্চাদের চেয়েও বেশী আদরের ছিল। যখন বিড়ালের নিজস্ব ছোট বাচ্চারা খুব ছোট  ছিল, তখন সে সেগুলিকে মুখে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানত্বরিত করতো যেটা বিড়ালদের স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু  এইভাবে সে তার বিড়ালছানাদেরই শুধু ধরে। সে কখনও মেয়েশিশুটির  উপর এই  চেষ্টা করে নি। প্রকৃতপক্ষে, ডাব-বেল্ট-জে প্রায়শই ভাবত যে মানব বাচ্চাগুলি  এত নগ্ন এবং অসহায় কেন জন্মগ্রহণ করে? একটি সময়ে এসে তার বিড়ালছানাগুলি নিজেরা খেতে পারে এবং তাদের লেজগুলি নিয়ে খেলা করে এবং একে অপরের সাথে দৌড়াদৌড়ি করতে এবং খেলতে পারে কিন্তু হনিগ-জে-তখনও হামাগুড়ি দিতে সক্ষম হয়নি। কাজেই বাচ্চাটি একজায়গাতেই শুয়ে বিড়ালটির সাথে খেলা করতো। 



তবে আরো অন্যান্য বিপদ ও এই ছোট মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করছিল। একদিন, যখন পুরুষরা শিকারে  বেড়িয়ে গিয়েছিল, এবং মহিলারা বাদাম এবং আকরট সংগ্রহ করার জন্য বনে চলে  গিয়েছিল, তখন একটি  সাংঘাতিক বন্যা এসে আওব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেল।  বন্যার জল ঘরগুলি ধুয়ে নিয়ে   ভাসমান নদীর তীরে এবং পরে সমুদ্রের দিকে নিয়ে ফেললো।

 

 

আলফ্রেড ও তাঁর স্ত্রী ফিরে এসে দেখলেন হানিগ-জে,ডাব-বেল্ট-জে, বেড়ালছানা আর সমস্ত গরুগুলোকে  বন্যার জল ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। হানিগ-জে কে বন্যার জল ভাসিয়ে নিয়ে গেছে এই ভেবে তাঁরা কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন।    

বন্যার জলের প্রচন্ড প্রবাহে বাড়িটি যখন হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে তখন হানিগ-জে ঘুমিয়ে ছিল।  বিড়াল তার বিড়ালছানাগুলিকে এতোদিনে ছেড়ে দিয়েছে কারন এরা এখন বেশ ভালভাবে বেড়ে উঠেছে এবং লাফিয়ে লাফিয়ে খেলা করতেও শিখে গিয়েছিল। তারা লাফিয়ে ক্র্যাডেলের শীর্ষে উঠে পড়েছিল এবং একসাথে ভাসতে ভাসতে অনেক দূরে এসে গেলো যেখানে কেউ দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না। কিন্ত্য  খুব তাড়াতাড়ি তারা এক মজাদার জিনিস দেখতে পেল সেটা ছিল একটি কাঠের জুতো।  যার মধ্যে চার দিনের পুরনো একটি ম্লান ছোট্ট হলুদ মুরগি ছিল। এখন ঘটনাটি হচ্ছে এইরকম , এটি যখন জুতোর মধ্যে খেলছিল  তখন বন্যা এসে এটিকে মা  মুরগির নীচে থেকে সরিয়ে নিয়ে দূরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আর মা মুরগি  তার সমস্ত বাচ্চা সহ দ্রুত বন্যার জলে ডুবে যায়।

অন্ধকার রাত নামার আগ পর্যন্ত ক্রমবর্ধমান বন্যা শিশু এবং বিড়ালছানাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। এইভাবে আরও কয়েক ঘন্টার জন্য প্রবহমান হয়ে নিরাপত্তার সাথে ক্র্যাডলটি একটি গ্রামের সামনে  এসে দ্রুত ঘুরপাক খেতে থাকে। বন্যার গতি বেড়েই চলেছিল। জল বেড়েই চলেছে আর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল আর জলের উত্থানের সাথে সাথে আরও জোরে জলের প্রবাহের গর্জন হতে  লাগল । 

এখন একটি বিড়াল রাতে দেখতে পারে, দিনের চেয়েও ভাল। অন্ধকার  যত গাড় হয়  ততই তাদের প্রশস্তভাবে  চোখ  খোলে। উজ্জ্বল রৌদ্রে দুপুরে বিড়ালের চোখের অভ্যন্তরীণ দৃষ্টির দরজাগুলি সরু থাকে, রাতের বেলা এই দরজাগুলি প্রশস্তভাবে খোলা থাকে। এ কারণেই ঘড়ি এবং ঘড়ি তৈরি হওয়ার আগের দিনগুলিতে বাচ্চারা বিড়ালের চোখের দিকে তাকিয়ে দিনের সময় সম্পর্কে জানাতে পারত। তাই কখনও কখনও তারা তাদের পালতু বিড়ালের নাম রাখতো  ক্লক-ওগ, যার অর্থ ঘড়ি-চোখ বা বেল আই। আর এইজন্যেই  বেল ঘড়িগুলি ডায়ালযুক্ত ঘড়ির চেয়ে বেশি আগে আবিষ্কৃত হয়। কারণ হল্যান্ডে ঘন্টার ঘন্টা এবং কোয়ার্টার বেজে থাকে।

 

বিড়াল এবং তার বাচ্চারা তাকিয়ে দেখল চার্চ টাওয়ার অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে।  সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের সমস্ত  শক্তি দিয়ে  মিউউউইউ করে চিৎকার শুরু করে দিল।  সে আশা করেছিল যে নদীর তীরের কাছে যে কোনও  একটি বাড়ির মধ্যে থেকে কেউ হয়তো শব্দটি শুনতে পাবে।  কিন্তু কারওই মনে হয় শুনে ও না শোনা বা মনোযোগ দেওয়া হয়নি এই আওয়াজে। শেষ অবধি, যখন বিড়াল যখন  প্রায় কাঁদতে কাঁদতে মারা যাবার উপক্রম হলো তখন একটি বাড়ির  জানালার একটিতে একটি আলো দেখা দিল। মনে হচ্ছিল যে কেউ একজন উঠে দাঁড়িয়ে আছে। এটি একটি বালক, যার নাম ছিল দার্ক।  সেইন্ট থিওডোরিকের নাম অনুসারে  যিনি অনেক আগে গ্রামে একটি গির্জা তৈরি করেছিলেন সেই থিওডোরিক চার্চের একজন ছিল দার্ক।  তাঁকে দেখে বিড়াল তার মুখ এবং ফুসফুসে সমস্ত জোর এনে আবার চিৎকার করে কান্না করে উঠলো।  তার কান্না শুনে গ্রামের অন্য বিড়ালরাও জেগে উঠে চিৎকার শুরু করে দিল। 

তাদের এই মিলিত কান্নার আওয়াজ দার্ক ছেলেটি শুনল। সে  ছুটে নীচে নেমে গেল এবং দরজা খুলে আবার শুনলো আওয়াজটি।  বাতাস তার মোমবাতিটি নিভিয়ে দিল কিন্তু  সাহসী ছেলেটি বিড়ালদের শব্দ  অনুসরণ করে করে  তীরে পৌঁছে সে হানিগ-জে দের দেখতে পায় । তৎক্ষণাৎ সে তার কাঠের ক্লোম্পস স্ফুরিত বন্যার জলে ফেলে দিয়ে ক্রেডেলের প্যাঁচালটি ধরে সেটিকে তীরে বেঁধে ফেলল  একটি খুঁটির সাথে। তারপরে সে  তার মাকে জাগিয়ে তুলে তার পুরষ্কার হিসাবে পাওয়া বিড়াল আর মানুষের বাচ্চাকে দেখালো। হানিগ-জে একদিকে হাসছিল এবং একদিকে কাঁদছিল সেই অবস্থায় সে দুধ খাওয়ানোর  দুধের শিংকে থাপ্পড় মারল এবং উষ্ণ দুধ তার মুখে  পরলে পর সে আনন্দে  পায়ের আঙ্গুলগুলি দিয়ে আবার লাথি মারল।  তা দেখে মা আর তার ছেলের খুব আনন্দ হল। বিছানার সামনে  মেঝের মাঝখানে, ডাব-বেল্ট-জে কে একটি বিছানার   পরিমান কিছু খড় দিয়ে বিছানা তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল এবং ডাব বেল্ট- জে  আনন্দের সাথে তাতে শীঘ্রই শিশুর মতো  ঘুমিয়ে পড়ল। 

এইভাবে বিড়াল ছেলেটিকে সতর্ক করে  এবং বাচ্চাটিকে বাঁচিয়েছিল। হানিগ-জে কে ছেলেটির পরিবার আপন করে নিয়েছিল কারন সেই পরিবারে কোন মেয়ে ছিল না কেবল একটি ছেলে ছিল।  এইভাবে আনন্দে দিন কাটতে কাটতে  হানিগ-জে   যখন এক যুবতী হয়ে বেড়ে ওঠে  তখন তাকে  রাজকন্যার মতো দেখতে হয়েছিল। অচিরেই গির্জার ডার্কের সাথে তার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো! এটি এপ্রিল মাস ছিল কাজেই সমস্ত  প্রকৃতি ফুলের শোভায় জেগে উঠছিল। যখন বিয়ের শোভাযাত্রাটি গির্জা থেকে বেরিয়ে আসে তখন ফুলের সদ্য প্রস্ফুটিত কুঁড়িগুলি তাদের মিষ্টি গন্ধে সমস্ত বাতাস ভরিয়ে দিল।

  

যথাকালে ঠিক নববর্ষের  আসার আগে তাদের এক পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। হানিগ-জের ছোটবেলার ক্র্যাডলেই সে তার শৈশব অতিবাহিত করে। একটু বড় হবার পর তার ঠাকুমা তার নাম রাখেন লুইড-ই-জের। ক্রমে তিনি বড় মিশনারি হয়েছিলেন  আর নাম হলো  ফ্রিজল্যান্ড। আজও হাজার বছর পরে যা ঘরে ঘর প্রচলিত একটি শব্দ। তিনি খারাপ,  মন্দ জাদুকর, দুষ্ট আত্মা এবং ভয়ানক রোগকে সেই অঞ্চল থেকে তাড়াতে সক্ষম  হয়েছিলেন। সর্বোপরি  তিনি "চোখের কামড়" নামে যাদুবিদ্যাকে দেশে নিষিদ্ধ করেছিলেন। লুইড-ই-জে  দুষ্টু এলভস এবং স্প্রেটিসদের জন্যও কঠোর আইন করেন  যারা পুরুষদেরকে বিভ্রান্ত করে দিতো। 

 

এর পরে, সেই অঞ্চলের  সমস্ত বাসিন্দা ভাল মানুষের পক্ষে থাকতে লাগলো। বিপদে আপদে  যাদের আন্তরিক হৃদয় এবং যারা মহিমান্বিত জীবনযাপন করে তাদের শরণাপন্ন হতে লাগলো। এর ফলে অঞ্চলটি বহুগুণ  সমৃদ্ধ হয়। সেখান থেকে নেকড়েদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বা হত্যা করা হয়েছিল। যার ফলে নেকড়েদের সংখ্যা ক্রমশঃ খুব কম হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে গবাদি পশু এবং ভেড়া বহুগুণ বেড়ে যায়  কারণ নেকড়েরা গৃহপালিত এই পশুদের আর উঠিয়ে নিয়ে যেতো না। ফলে  প্রত্যেকের কাছে পশমের পোশাক পরিধানের জন্য উপলব্ধ ছিল এবং অঞ্চলের প্রত্যেক ব্যক্তির একটি করে গরু ছিল।  

 

কিন্তু লোকেরা এখনও বন্যায় তাণ্ডব থেকে মুক্তি পায়নি। প্রত্যেক বছর তারা বন্যার জন্য ভুগছিল।  যে সময় জোয়ার আসে তখন গবাদি পশু এবং মানবদেহকে ভাসিয়ে  নিয়ে চলে যায় সমদ্রে।  তারপরে লুইড-ই-জে নিজে ধর্মপ্রচারক হিসাবে অঞ্চলের পুরুষদের শিখালেন কীভাবে ডাইকস তৈরি করতে হয়, যা সমুদ্রকে দূরে  রাখে এবং নদীর জলকে নদীর তীরেই সীমাবদ্ধ করে রেখে দেয়, এতে করে শেষ পর্যন্ত বন্যার পরিমাণ খুব কমে গিয়েছিল।  এইসব ঘটনার পর একদিন সান্তা ক্লাস এসে পৌঁছেছিলেন সেখানে এবং মানুষের হৃদয়কে   প্রাণবন্ত রাখার জন্য ভালবাসা, দয়া ও চিত্তের চেতনাকে চিরকাল ধরে রাখার কৌশল শিখিয়েছিলেন। 

 

শেষ অবধি, যখন প্রায় একশো বছর কেটে গেল  হানিগ-জে যে কিনা এই অঞ্চলে শিশু থেকে বৃদ্ধা অবস্থা  দেখেছিলেন মারা গেলেন। তিনি সবারই প্রিয় বৃদ্ধা ছিলেন। যিনি সবার প্রতি সদয় ছিলেন এবং সান্তা ক্লসের জন্য পথ প্রস্তুত করেছিলেন মারা গিয়েছিলেন তাই সবাই শ্রদ্ধা বরে তাঁকে গির্জাতেই সমাধিস্থ করেন। তারপরে,  ডাব-বেল্ট-জে বিড়াল, যার নবমতম বাচ্চাটি যাকে সবাই ডাব-বেল্ট-জেই ডাকতো হানিগ-জের সাথেই মারা গেল। অঞ্চলের বাসিন্দারা বৃদ্ধা  মহিলাকে গির্জার আঙনের নীচে কবর দিয়েছিল এবং সবার প্রিয়  বিড়ালের মৃত দেহকে সামনে রেখে দিল। যথাসময়ে যখন  বিড়ালের লেজ এবং পশম টুকরো টুকরো হয়ে ঝরে পড়ল এবং কান ফেটে পড়ল এবং কাচের চোখ ছিটকে বেড়িয়ে গেল, তখন একজন দক্ষ শিল্পী ডাব-বেল্ট-জে'র একটি মূর্তি তৈরি করে বৃদ্ধার সমাধির উপর স্থাপিত করলেন। যা এখনও গির্জার সমাধির উপরে দাঁড়িয়ে  আছে। প্রতিবছর, ষষ্ঠ ডিসেম্বর সান্তা ক্লসের দিনে, শিশুরা তার গ লায় একটি নতুন কলার পরিয়ে দেয় এবং বিড়াল সম্পর্কে কথা বলে যা একটি শিশুর জীবন বাঁচিয়েছিল। 

 


No comments