DEHLIJ

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

হারানো দিনের কথাঃ মেহেদী হাসান ও বাংলা গান




জুন ১৩, ২০১২ সাল। প্রয়াত হলেন 'শাহেনশা এ গজল' উস্তাদ মেহেদী হাসান। দীর্ঘ একদশকের বেশি সময় গুরুতর অসুস্থ থাকার পর করাচিতে নিভে যায় তার জীবন-প্রদীপ। রাজস্থানের লুনা থেকে, ১৯২৭ সালে যে অবিস্মরণীয় যাত্রা শুরু হয়েছিল তার, করাচির আগা খান হাসপাতালে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। 


আজ আট বছর হতে চললো তিনি নেই। অথচ, তার গান ঘিরে অনাবিল উন্মাদনা আজও ভারত পাকিস্তান দুই দেশের অসংখ্য সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ, গুণমুগ্ধ শ্রোতাকে এক সূত্রে বেঁধে রেখেছে। তিনি সাক্ষাৎ কিংবদন্তি। তাকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলা ধৃষ্টতা। পাকিস্তানের পাশাপাশি চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি দাপিয়ে বেরিয়েছেন এই উপমহাদেশের আনাচে-কানাচেও। আজও গজল ও লঘু শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অবিংসবাদী সম্রাট তিনি, একদা লতা মঙ্গেশকরের মত শিল্পী যার সম্মন্ধে বলেছিলেন, তার গলায় স্বয়ং ঈশ্বরের অধিষ্ঠান।



'ওয়ালিদ' উস্তাদ আজিম খান ও 'চাচা' উস্তাদ ইসমাইল আলী খান নির্দেশিত সুরের পথ ধরে তার গজলের অবিস্মরণীয় সফর যে কোন রূপকথাকে হার মানায়। সারাজীবনে ২৫ হাজারেরও বেশি উর্দু ও হিন্দি গান, বলিউড ও ললিউডে (লাহোর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি) অসংখ্য সিনেমায় প্লে ব্যাক, অগুনতি পুরস্কার ও সম্মানে ভেসে জীবদ্দশাতেই যিনি হয়ে উঠেছিলেন 'লিজেন্ড'... সেই মেহেদী হাসানের বঙ্গ প্রীতি, বাংলা গান ও বাংলার শিল্পীদের প্রতি তার সম্মানের অশ্রুত আখ্যান কোথাও যেন নিঃশব্দে হারিয়ে গেছে কালের অজ্ঞাত নিয়মে। 



মেহেদী হাসান মানে শুধুই 'রঞ্জিশ হী সহী', 'অব কে বিছরে', 'গুঁলো মে রঙ্গ ভরে', 'পাত্তা পাত্তা বুটা বুটা', 'জানতা হু কে বেওয়াফা তু হ্যায়', 'একবার চলে আও', বা 'তেরি আঁখো কো যব দেখা'র মত অবিস্মরণীয় গজল নয়, রয়েছে বেশ কিছু বিস্মৃত বাংলা গজল ও আধুনিক গানও, একসময় যার সুরে মাতোয়ারা হয়েছিল দুই বাংলার সঙ্গীতপ্রেমী মানুষেরা। সে সব কীর্তি অনাদরে রয়ে গেছে আজ। বাঙালি শ্রোতা তার কতটাই বা মনে রেখেছে, সে নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।



ষাটের দশকের শেষ ও সত্তরের মাঝামাঝি বহুবার ঢাকা এসেছেন মেহেদী। হাতেগোনা বেশ কিছু গান ও প্লে ব্যাক করেছিলেন তিনি। বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে জানা যায়, বাংলাদেশের তিনটি চলচ্চিত্রে বাংলা গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন মেহেদী হাসান। সেই সময় জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠে গানগুলি। এর মধ্যে 'তুমি যে আমার ভালোবাসা', 'হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়', বা 'ঢাকো যত না নয়ন দু হাতে'র মত গানগুলি মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ষাটের দশকে মুক্তিপ্রাপ্ত 'হারানো সুর' ছবিতে নায়ক রহমানের কন্ঠে 'হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়' গানটি গেয়েছিলেন হাসান। শুধু এই গানের জন্যই ছবিটি সুপার হিট হয়েছিল। গানটি লিখেছিলেন বিখ্যাত গীতিকার আশরাফুজ্জামান খান ও সঙ্গীতকার ছিলেন চিটাগঙের মোহনলাল দাস। ১৯৬৭ সালে মেহেদী হাসানের চট্টগ্রাম সফরের সময় গানটির সৃষ্টি হয় বলে মনে করেন অনেকে। মানঝ খাম্বাজে কিংবদন্তি ডি ভি পালুস্করের বিখ্যাত রাম ভজন 'যব জানকীনাথ সহায়'র ছায়া পাওয়া যায় এই গানটিতে। আশরাফুজ্জামান ও মোহনলালের সুরে আরও একটি অসাধারণ লঘু শাস্ত্রীয় 'ফাগুনেরো দখিন বায়' রেকর্ড করেছিলেন খাঁ সাহেব। গানটি ১৯৬৩-৬৪ সালে রেডিও পাকিস্তান থেকে প্রচারিত হয়েছিল বলে জানা যায়। 



১৯৮২ সালে মুক্তি পেয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্র 'রাজা সাহেব'। সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন আলী হুসেইন ও গীতিকার ড. মনিরুজ্জামান। মেহেদী হাসান গাইলেন 'ঢাকো যত না নয়ন দু'হাতে'র মত গানটি। সাড়া পড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশে। শোনা যায়, প্রথমে এই গানটি গাইতে রাজি হননি মেহেদী হাসান। কারণ, পাহাড়ি রাগে নিবদ্ধ এই গানটির সুরে লতা মঙ্গেশকরের বিখ্যাত 'রহেনা রহে হম' (মমতা, ১৯৬৬ সাল, সুরকার রোশন) র ছায়া ছিল স্পষ্ট। পরে অবশ্য রাজি হন মেহেদী। ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল গানটি। এর আগে প্রায় একই সুরে মেহেদী গেয়েছিলেন 'যব ভি চলেঙ্গে শাঁওন কী ঝোঁকে, কালী ঘটা তুঝে সোনে না দেগী'। এক উর্দু ছায়াছবি 'বাজুবন্ধে'র জন্য সে গান রেকর্ড করেন মেহেদী, যদিও কখনো মুক্তি পায়নি ছবিটি। প্রায় সমকালীন সময়ে মেহেদী হাসান গেয়েছিলেন 'তুমি আমার ভালোবাসা'র মত গানটিও। বিখ্যাত গজল 'মেরি জিন্দেগী মেরে পাস আ' অনুপ্রাণিত এই গানটিও প্রবল জনপ্রিয়তা পায় গোটা বাংলাদেশে। 



শুধু ওপার বাংলা নয়, এপার বাংলাতেও মেহেদী হাসান ছিলেন সমান জনপ্রিয়। ষাট সত্তরের দশকে তার গাওয়া বাংলা গানগুলি দুই বাংলার মানুষের মুখেমুখে ফেরে। অথচ উস্তাদ মেহেদী হাসান নিজে ছিলেন দুই কিংবদন্তি বাঙালি শিল্পী মান্না দে এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গায়কীর গুণমুগ্ধ। সুবিখ্যাত কবি হরিবংশ রাই বচ্চনের 'মধুশালা'য় যখন নিজ কন্ঠের জাদু ঢালেন মান্না দে, সেই গান শুনে উস্তাদ মেহেদী হাসান বলেছিলেন, 'ঈশ্বরের অসীম কৃপা থাকলে কোনো মানুষ এমন সুরের উৎকর্ষতা স্পর্শ করতে পারে।' মান্না দে'র রাগাশ্রয়ী গানের বিরাট ভক্ত ছিলেন খাঁ সাহেব। আর ততধিক শ্রদ্ধা এবং অনুরাগী ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠের। মেহেদীর মতে, তামাম হিন্দুস্তানের সেরা 'ফনকার' ছিলেন হেমন্ত। স্বয়ং ঈশ্বরের আশীর্বাদ তার কন্ঠে পরিব্যাপ্ত। খুব কম মানুষ জানেন, আটের দশকের শেষে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যখন অসুস্থ, তখন মুম্বই সফরে এসেছিলেন মেহেদী। হেমন্তবাবুর অসুস্থতার খবর শুনে তৎক্ষনাৎ কলকাতা উড়ে আসেন তিনি। দমদম এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি নিয়ে সোজা হাজির হয়েছিলেন তার শ্রদ্ধেয় 'দাদা'র বাড়ি। খোঁজখবর নেন তার স্বাস্থ্যের। এমন পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও শ্রদ্ধাবোধ আজকের দিনে বিরল। 



'আফতাব এ গজল' মেহেদী হাসান 'জন্নতনসিব' করেছেন প্রায় আট বছর হল। কিন্তু আজও তার গাওয়া অজস্র গান অটুট মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে রেখেছে সারা বিশ্বের হাজার হাজার সঙ্গীতপ্রেমী মানুষদের। তার গায়কী, বুলন্দ আওয়াজ, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম ও সর্বোপরি সুরের জগতের প্রতি তার আবেগ, নিষ্ঠা ও ভালোবাসা তাকে আজ যে উচ্চতা দিয়েছে, বোধকরি আগামী শতাব্দীতেও তার সেই শ্রদ্ধার আসন অক্ষুণ্ণ থাকবে। তাই শুধু উর্দু বা হিন্দিতে গাওয়া তার অমর রচনা নয়, দুই বাংলার সুরে মিশে থাকা তার নির্যাস আহরণ করা সমান প্রয়োজনীয়। তা যেন কখনোই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে না যায়। 



কিংবদন্তি শিল্পী মেহেদী হাসানের সুরের রেশ ধরে 'হারানো দিনের কথা' আবারও ফিরে আসুক এই বাংলায়...আমরা খুঁজে পাই সেই মানুষটিকে যার জীবনের এক অনন্যসাধারণ অধ্যায় জড়িয়ে আছে দুই বাংলার মাটিতেই। সেই অধ্যায় যা ক্রমশ ভুলে যেতে বসেছি আমরা ও ভুলতে বসেছে আমাদেরই বর্তমান প্রজন্ম...ঘুরে দেখবার সময় হয়েছে এবার।



* তথ্য ঋণঃ 



১. 'দ্য ডন' সংবাদ পত্রিকা, করাচি, পাকিস্তান

২. 'দ্য হিন্দু' সংবাদ পত্রিকা, নয়াদিল্লি, ভারত 

৩. 'প্রথম আলো' সংবাদপত্র, ঢাকা, বাংলাদেশ

৪. নাসের ইয়ামিন, ঢাকা, বাংলাদেশ 

৫. সুখেন্দুশেখর রায়, সাংকলকাতা, ভারত

No comments