DEHLIJ

অঞ্জন সরকার









খিচুড়ি,সিগারেট। 

    

       বৃষ্টি পড়ছিল, খুব জোরে নয়, কিন্তু ছাতা ছাড়া ভিজতে হবে। কোনমতে ঘাড়ে ল্যাকপ্যাকে পুরানো ছাতাটা চেপে ধরে, এক হাতে সিগারেটের প্যাকেটটা বাঁ দিকের পকেটে ঢোকালাম, আর তারপরে খুচরো টাকাগুলো ডান দিকের পকেটে রাখলাম। রতনটা তো দোকান বেশ নতুন সাজিয়ে বসেছে। যদিও পাড়ার মুদির দোকানের সামনের একটু জায়গায় ছোট্ট মাচা করে পান সিগারেটের দোকান দিয়েছে, তাও ফুটপাতের জাত থেকে তো উঠেছে! পাড়ার গাড়ি চড়া সায়েবরা, যারা তখন রতনের টিনের ট্রাঙ্কের ওপর ফুটপাতের দোকানে থামত না, আজকাল ওর দোকানের রেগুলার খদ্দের। আর এখন ব্যাটা ধারে দিতে চায় না। বলে, এত কাস্টমারের বাকি’র হিসেব রাখা সম্ভব নয়। গাড়ি চড়া বাবুদের, সিগারেট, পান, সোডার বোতলের হিসেব নাকি মাসকাবারি হিসেবে চলে। দোকানে ছাপ্পান্ন  টাকা গচ্চা দিয়ে, পুরো প্যাকেটই কিনেছি।

       আজ পনের দিন হয়ে গেল, কোন কাজ নেই। সাহা বিল্ডারের সব কাজ এখন বন্ধ, কোরোনার দয়ায়। টেম্পোরারি চাকরি, সাইটের স্টোরের কাজ ছিল, কোন পাকা চাকরি নয়। পনের দিনের ক’রে, একসঙ্গে মজুরী দিত। বলেছে কাজ শুরু হলে ডাকবে।

            বাড়ি ফেরার পথে আজ দেখলাম দিলিপের দোকানে খিচুড়ি আর বেগুনী  দিয়ে লোকদের  ডাব্বা তৈরি করে দিচ্ছে। ষোল টাকা প্লেট। বাড়ি গিয়ে শিউলিকে বলবো খিচুড়ি বানাতে। অনেকদিন ধরেই তো আলু সিদ্ধ ভাত, নয় কাঁচকলা, কুমড়ো দিয়ে ফেনভাত, আর বেগুন পোড়া, ভাত। সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী, সামনের সপ্তাহে হয়ত সাহা বিল্ডারের অফিস থেকে কিছু মাইনের অংশ হিসেবে দেবে। আজ দুপুরের খাওয়া খেয়েই না হয় সিগারেটের প্যাকেটটা খোলা যাবে।

            ঘরে ঢুকতে দেখি শিউলি কোলের ছেলেটাকে ঘুম পাড়াচ্ছে। ছেলেটাকে, দুটো জানলার শিকে বাঁধা শাড়ির দোলনায় শুইয়ে দিয়ে, ভেতরের বারান্দায় ছোট রান্নার জায়গার দিকে চলল। ডেকে বললাম, “হ্যাঁগো! খিচুড়ি বানাবে?” 

            এক সেকেন্ডের জন্য দাঁড়িয়ে, মাথা নিচু করে বললে, “বাড়িতে ডাল নেই। চালও কয়েক দিনেরই আছে।” পেছন ফিরে যেতে যেতে, যেন একটু ধরা গলায় বলে গেল, “ ছেলেটার দুধের পাউডারও প্রায় শেষ। বুকের দুধে তো কুলোবে না!” শাড়ির আঁচলটা কি চোখের দিকে তুলতে দেখলাম!

      ছেলেটার, শিউলির, কথা না ভেবে, আমি খিচুড়ি বেগুনি খেয়ে সিগারেট ফোঁকার স্বপ্ন দেখছিলাম! নিজের পেছনে ত লাথি মারা যায় না, পারলে, মারাই উচিত ছিল! ধুস শালা!নিকুচি করেছে সিগারেটের! পকেটে এখনো একটা পাঁচশ, আর একটা একশ টাকার নোট, আর  চুয়াল্লিশ  টাকা আছে রতনের দোকানের ফেরত।সিগারেটটা না কিনলে, তাও পকেটে আরও একটু কিছু টাকা থাকতো। 

     

            ঠিক মিনিট পনেরোর মধ্যে শিউলির সামনে এনে রাখলাম প্যাক করা দিলিপের দোকানের দু প্লেট খিচুড়ি আর চারটে বেগুনী। গুঁড়ো  । 


একটি ছোট গল্পের প্রচেষ্টা পাঠালাম। আশা করি অন্তর্ভুক্তির উপযুক্ত বিবেচিত হবে।    



একটি সাক্ষাৎকার


তেইশ-চব্বিশ বছরের দীপেন সান্যাল, দিল্লির কাশ্মীরি গেট বাস টারমিনাসের ওয়েটিং হলে’র এক কোনে বসে, মোরাদাবাদের বাসের জন্য অপেক্ষায়। নতুন চাকরিতে জয়েন করবে। ওয়েটিং হলে কিছু লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। হলের ঠিক উল্টোদিকে, এসক্যালেটরের দরজার কাছেই, একটি উগ্রপ্রসাধন সজ্জিতা মেয়ে পর্যাপ্ত যৌবন প্রদর্শন করে, আপাতদৃষ্টিতে অপেক্ষায় বসে আছে। দ্বীপেনের নজর প্রায়ই মেয়েটির দিকে চলে যাচ্ছিলো, আর চোখাচোখি হওয়ার মুহূর্তেই দীপেন নজর সরিয়ে নিচ্ছিল। মেয়েটি বেশ স্মার্ট দেখতে, ও অধুনা চলতি ফ্যাশানের চটকদার অফ্-শোলডার টপের সঙ্গে আঁটোসাটো জীন্স পরেছে। যেন, সঙ্গ ইচ্ছুক পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই এই রকম পোষাক। দু একবার দীপেনের সঙ্গে চোখাচোখিও হয়ে যায়। মেয়েটিও যেন টের পেয়ে, একটু ঔৎসুক্যের চাহুনি দিয়ে তাকিয়েছিল দু একবার।দীপেনের নজর সে টানতে পেরেছে। আজকাল নাকি অনেক হোটেলের ওয়েটিং লাউঞ্জে, এয়ারপোর্টে, ইন্টার-স্টেট বাস টারমিনাসের ওয়েটিং হলে, এরকম মেয়েছেলেদের দেখা যায় সন্ধ্যার দিকে।


মেয়েটি নিজের ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন বার করে, কাউকে ফোন করে। ইংরেজিতে কাউকে জানায়, “ আই শ্যাল বি আ বিট লেট। ডোন’ট ওয়ারী, আই শ্যাল বি দেয়ার বিফোর ডিনারটাইম!” এক মিনিট কথা বলেই ফোনটা আবার ব্যাগের ভেতরে রেখে দেয়। বাইরে কোন দূর পাল্লার বাসের প্রস্থান মুহূর্ত ঘোষণা করা হয়, ও তার সঙ্গেই ওয়েটিং হলে’র অনেকেই উঠে বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যায়। দীপেনের বাসের সময় এখনও প্রায় আধ ঘন্টা বাকি। বিরাট হলের মধ্যে থেকে যায় মাত্র চার পাঁচজন অপেক্ষারত যাত্রী, দ্বীপেন ও সেই মেয়েটি।


একটু পরেই, হলের বাইরে এসক্যালেটরের দিকে চোখ যেতেই, দীপেন দেখে মেয়েটি তার হাতের ব্যাগ ও ক্লাচ-পার্স নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটি মনে হোল তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। চোখে চোখ পড়তে, মেয়েটি, পা বাড়িয়ে, দীপেনের দিকেই এগোয়। দীপেন একটু সন্ত্রস্ত হয়ে নড়েচড়ে বসে। আসন্ন কোন সাঙ্ঘাতিক ঘটনার উৎকণ্ঠা তার চোখেমুখে। মেয়েটি দীপেনের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়। তার চাপা ঠোঁটে, হাসির ইঙ্গিত, না তিরস্কারের পূর্বলক্ষণ, দীপেন বুঝে উঠতে পারে না।


দীপেনও এতক্ষনে উঠে দাঁড়িয়েছে। একটু যেন ভয়ই পেয়েছে। একাধিকবার তাকানোর জন্য তিরস্কার, এমনকি একটা চড় কষিয়ে দেয় যদি!


দীপেন কিছু বলার আগেই, চোখে চোখ রেখে, সেই হেঁয়ালি ভরা দৃষ্টিতেই, মেয়েটি বলে ওঠে, “কি! চেনা মনে হচ্ছে? চল না ওই কোনাটায় গিয়ে বসি, নিরিবিলিতে কথা বলা যাবে।” বলেই, মেয়েটি দীপেনের হাত ধরে প্রায় টেনে নিয়ে যায় হলের ভেতরের কোনের দিকে। দীপেন যেন যন্ত্রচালিতের মতন হলের কোনের দিকে এগিয়ে যায়।


মেয়েটিও তাহলে বাঙালি, অথবা বাংলা ভালো জানে।


-“চেনা’র চেষ্টা করছিলে, না আলাপ করার চিন্তা করছিলে”


দীপেন ভেবে উঠতে পারছে না কী বলবে।তখনও সন্ত্রস্ত ভাব পুরো কাটে নি।


-“তুমি দিপু না? দীপান্বিতাদি’র ভাই? বিষ্ণুপুরের বসাকপাড়ায় বাড়ি তো?” দীপেন সম্মতিতে একটু ঘাড় নাড়ে।


-“ ব্রজমন্দির স্কুলে পড়তে। সাইকেলে স্কুলে যেতে।”


দীপেনের অবস্থা প্রায় হতবাক, কোনঠাসা। চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাপ প্রকট। কোনমতে মাথা হেলিয়ে জানায়, "হ্যাঁ, দীপান্বিতা সান্যাল আমার দিদি।"


মেয়েটি আরো বলতে থাকে, “দীপান্বিতাদি তো লেখাপড়ায় বেশ ভালো ছিলো। এমএ’তে ভর্তি হয়েছিল না? তুমি বি এ পাস করেছ?”


দীপেন মৃদুস্বরে জবাব দেয়, “হ্যাঁ। এম বি এ করেছি।”


“দীপান্বিতাদির বি এ পাস করার কয়েক মাসের মধ্যেই ত মেশোমশাই মারা যান। সংসার চালানো, মা’য়ের দেখাশোনা, ভাইয়ের লেখাপড়া, এইসব দায়িত্ব দীপান্বিতাদির ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। তার পর থেকেই ত দীপান্বিতাদি টিউশানি’র পেশাটা ধরে নেয়।”


দীপেন এতক্ষন পরে, ইতস্তত করে জিজ্ঞ্যেস করে- ‘আমাদের সম্বন্ধে এত কিছু বলার পরেও কিন্তু নিজের পরিচয়টা দিলে না! ঠিক চিনে উঠতে পারছি না । তুমিও কি বসাকপাড়ায়...’


দীপেনকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে মেয়েটি বলে ওঠে “আমাকে চিনলে, কি না চিনলে, তা’তে কিছু আসে যায় না। পেশাটা, চেষ্টা করে, আন্দাজ করছ বোধ হয়?... দীপান্বিতাদি ত এখনও বিয়ে করেনি, তাই না? তুমি কি সমীরনদাকে চেনো? সমীরনদাও তো এখনও বিয়ে করেনি।”


দীপেনের আশ্চর্য ভাবটা এবার বিদ্ধস্ত হতভম্বে বদলে যায়। ছুটির সময়, বাড়িতে গিয়ে,সমীরনদাকে ত এখনও, টিউশানি থেকে ফেরার পথে, দিদির সঙ্গে দেখা করতে দেখেছে কয়েকদিন। দীপেন মনের আনাচে কানাচে খুঁচিয়ে চেষ্টা করে স্কুলজীবনের বন্ধু বান্ধবীদের নাম মনে করতে। কিছুতেই, চেহারার সঙ্গে নাম মিলিয়ে মনে করতে পারে না। দীপেনের প্রশ্নের জবাবে মেয়েটি সরাসরি পরিচয় দিচ্ছে না।


মেয়েটি দীপেনের দিকে সেই ঠোঁট টেপা স্মিত হাসি মুখে দু এক মুহূর্ত তাকায়। একটু পরেই, মেয়েটির গলা যেন স্বগতোক্তির মতন কিছুটা ভারী শোনায়।




No comments