DEHLIJ

অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শর কলম্‌



সকালটা সেদিন নরম রোদে হাসছিল। ভিস্তিওয়ালারা রাতের অন্ধকার থাকতেই চাঁদনী চকের রাস্তা ধুয়ে সাফ করে দিয়ে গেছে। একটা দুটো করে দোকান খুলছে। অন্য একটা সাধারণ দিনের মতোই ফোয়ারার আসেপাশে ভবঘুরেদের আনাগোনা চলছে। সারা রাত নেশা করে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা মাতালটাকে খুঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করছে নগর পাহারাদার। আর সেই দৃশ্য দেখে হাসাহাসি করছে রাস্তার যত লোক। ফুলওয়ালীরা পশরা সাজাচ্ছে। তাদের সাথে রসিকতার রসে সিক্ত হতে ভিড় জমাচ্ছে ভিনদেশী মানুষেরা। সকালটা মনোরম হলেও বেলা গড়াতেই রোদের তেজ বাড়তে শুরু করল। তখনি লাহোরী দরজার দিকে আঙুল তুলে ইশারায় সতর্ক করে দিল শাহি পাহারাদার। রাস্তার ধারে জটলা করা অলস লোকগুলো সেদিকে তাকিয়ে রইল বিস্ময়ে। 

শোভাযাত্রা কাছে আসতে দেখা গেল— মন্থর গতিতে, দুলকি চালে চলা দুই হাতি, তাদের পাশে মাহুতের দল। হাতির উপরে সওয়ার দুই মানুষ। ছোট্ট শোভাযাত্রাটা লাহোরী দরজা থেকে চাঁদনী চকের রাস্তায় উঠে পড়ল। কেল্লা থেকে কারা বেরোল? শাহি শোভাযাত্রার জাঁকজমক তো দেখার মত হয়! নিঃশব্দে এ কোন শোভাযাত্রা? না আছে লোকলস্করের দাপট, না বাজনা। হাতির পিঠে মানুষ দুটোর মাথায় বাহারি ছাতাও নেই। চকের রাস্তার দুই ধারে একটু সরে গিয়ে মানুষজন কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। 

দলটা আর একটু কাছে আসতে দেখা গেল হাতি দুটোর উপর কোনও হাওদা নেই। তাদের খোলা পিঠের উপর দুজন মলিন বসন পরা মানুষ। দুই পায়ে তাদের লোহার শিকল বাঁধা। হাতির পিছনে খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে তিনজন সেপাই। 

কেতাবের ব্যাপারি শেঠ পেরুমল সবে দোকান খুলে চারিদিকে গঙ্গাজল ছেটাচ্ছিল। দোকানের সামনে হাতি দুটো চলে আসতেই সে সভয়ে বলল, “আরে সব্বোনাশ! এ যে শাহজাদা দারাশিকো! হায় ভগবান, এই দৃশ্যও দেখার ছিল!” 

পেরুমলের চিৎকার শুনে ফুলওয়ালি মীনাবাঈ তার হাত থেকে মালার গোছা ছুঁড়ে দিয়ে দৌড়ে গেল হাতির দিকে। এক ধমকে মাহুতেরা তাকে তফাত যেতে বলল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মীনাবাঈ। সে জানে না, কোন অপরাধে কোমল হৃদয়ের শাহজাদার আজ এই শাস্তিবিধান।

চোখের জল মুছতে মুছতে অস্ফুটে মীনাবাঈ বলে, “হিন্দুস্তানের সূর্য অস্ত যেতে বসেছে। এই শহরে মানুষের আর ঠাই হবে না এখন।”

মীনাবাইয়ের আপ্ত সহায়িকা রসিলা বানু কিছু না বুঝে উঠতে পেরে জিজ্ঞেস করে, “কী হল গো দিদি? কাকে শাস্তি দিতে বেঁধে নিয়ে চলেছে সেপাইরা?”

“শাহজাদা দারাশিকো! দিল্লির মসনদে বসেছেন শাহজাদা আলমগির। পাদশাহ শাহজাহান এখন আগ্রার কেল্লায় বন্দী। ভাইয়ে ভাইয়ে রক্তক্ষয়ের এই ফলাফল! হায় কপাল, এবার মনে হয় ব্যবসার বারোটা বাজবে। শুনেছি নতুন শাহেনশাহ খুব শক্ত ধাতের মানুষ। আমরা কেউ তাকে কখনো শোভাযাত্রা করতে দেখিনি দিল্লির রাস্তায়। আর করবেনই বা কীভাবে? সারাজীবনই তার কেটেছে যুদ্ধে। কানে সবই আসে। বুড়ো শাহেনশাহ এখন অথর্ব। নতুন সম্রাটের আমলে কপালে কী লেখা আছে কে জানে?”

“হাতিগুলোকে দেখো দিদি, যেন কবরে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে আছে। একেবারে বুড়ো থুত্থুড়ে...।”

“ইচ্ছে করেই এই বৃদ্ধ হাতিদের পিঠে চড়িয়েছে হতভাগ্য শাহজাদাকে। তার গায়ে ওরা চাপিয়েছে চটের বস্তা দিয়ে বানানো পোশাক। আহা রে, ওই কোমল অঙ্গে এই পোশাক না জানি কত ক্ষতর সৃষ্টি করছে।”

“আর একজন কে গো দিদি? আহা রে, ওর গালে এখনো দাড়ি গজায়নি। নিশ্চয়ই শাহজাদার ছেলে হবে!”

“হবে হয়তো। এই কিছুদিন আগেও শাহজাদার পোশাকে লাগানো মণিমাণিক্য থেকে আলো ঠিকরে পড়ত। তৈমুরের রক্ত ওদের শরীরে। আজ আর দোকান সাজিয়ে কাজ নেই। বরং বাড়ি ফিরে যাই চল। শহরে আবার কাজিয়া না বাধে!”

মীনাবাঈ দোকান বন্ধ করে চোখের জল মুছতে মুছতে ঘরে ফেরে। তার বুকে শাহজাদার অনেক স্মৃতি। একেবারে তরুণ বয়সে পাদশাহ শাহজাহানের প্রথম সন্তান দারা, চাঁদনী চকের রাস্তায় মানুষের সাথে খোলামেলা ভাবে মিশত, গল্প করত। তার পোশাক আর আচার আচরণে যতই পাদশাহি আভিজাত্য থাকুক না কেন, সেই সব দূরে সরিয়ে রেখে, মানুষের মাঝে দারা যেন অতি চেনা মানুষ ছিল। এমনকি যে সব ভবঘুরেরা নেশাভাঙ করে চাঁদনী চকের রাস্তায় গড়াগড়ি খেত, তাদের কাছে ডেকে আপন করে নিতে সময় লাগত না শাহজাদার। ফকির আর দরবেশদের ভিড় লেগে থাকত তাকে ঘিরে। মোগল রাজবংশের আর একজন মানুষও এমনভাবে নিজেকে মেলে ধরে দিতে পারেনি মানুষের মাঝে। মনে হত বেহস্তের কোনও জীন যেন মাটিতে নেমে এসেছে। 

শেঠ পেরুমল কেতাবের উপর রোজকার মত ধুলো ঝাড়তে গিয়েও কী যেন মনে করে দোকানের ঝাঁপ ফেলে দেয়। শাহজাদা অনেকদিন তার দোকানে আসেননি ঠিকই, কিন্তু পণ্ডিত মানুষটার বড় কৃপা তার উপর। সংস্কৃত আর ফার্সি ভাষায় সমান দক্ষ - শাহজাদা দারাশিকো। 

পার্সিয়া থেকে নতুন কেতাব আনিয়ে দেওয়ার বায়না করে হাসতে হাসতে বলতেন, “পেরুমল, আমার পকেটের দিকে লক্ষ্য রেখ, বেশি দাম নিও না যেন! আব্বাহুজুর বড় বড় ইমারত বানিয়ে খুশি হন, তাতে অগাধ টাকা ঢালেন... কিন্তু তিনি ছেলেদের মাসহারা কম দেন।” 

পার্সিয়া থেকে কেতাব এসে গেলেই মহানন্দে স্বয়ং দোকান থেকে নিয়ে যেতেন দারা। মূল্য জিজ্ঞেস না করেই একরাশ মোহর ঢেলে দিয়ে যেতেন পেরুমলের বাক্সে। দিলটা ছিল তার দরিয়ার মত উচ্ছল। পেরুমলের  দোকানের যত শ্রীবৃদ্ধি তার একটা বড় কৃতিত্ব শাহজাদা দারাশিকোর কেতাবের প্রতি দুর্বলতা। 

দারাশিকোকে নিয়ে শোভাযাত্রা ফতেহপুরি মসজিদের দিকে এগিয়ে যায়। মধ্য গগনের সূর্য তখন আকাশ থেকে আগুন ঢালতে শুরু করেছে। তেতে ওঠা রাস্তায় বুড়ো হাতিদুটোও যেন আর চলতে চাইছে না। কপাল থেকে ঘাম মুছছে তরোয়ালধারী সেপাই। শাহজাদা দারাশিকো ক্ষীণ কণ্ঠে প্রার্থনা করলেন, “আমায় একটু জল দেবে কেউ? একটু জল?”

শুনেও না শোনার ভান করল মাহুত। তাদের উপর উজিরের কড়া নির্দেশ— একফোঁটা জল দেওয়া চলবে না শাহজাদা দারা আর তার কিশোর পুত্র সুলেইমনকে। সারা শহর ঘুরবে এই শোভাযাত্রা। মানুষ দেখবে শাহেনশাহ আলমগিরের বিরুদ্ধাচারণের শাস্তি কী। তারা শিউরে উঠবে, বশ্যতা মেনে নেবে নতুন শাহেনশাহর। যতদিন আওরঙ্গজেব শাসন করবেন, ততদিন বিদ্রোহীরা আর মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস করবে না। 


শাহজাহানাবাদের কেল্লার পিছনে সেই রাতে যমুনার জলে চাঁদের আলো পড়ে হাজার কোটি হীরের কণা যেন চিকচিক করছিল। রাতের দ্বিতীয় প্রহরে শান্ত চরাচরে মিষ্টি বাতাস খেলা করে যাচ্ছে। দিনের তপ্ততার পর যমুনার জল এখন ঠাণ্ডা শীতল। কেল্লার রোশনাই বাতিদান সব নিভে গেছে। শুধু অলিন্দগুলোয় আলো জ্বলছে টিমটিম করে। যমুনার পাড়ের সিঁড়ি দিয়ে চুপিসারে তিনটি মানুষ খুব ধীরে ধীরে জলের দিকে এগুচ্ছে। 

সিঁড়ির নিচে নৌকা প্রস্তুত করে দুই মাল্লা অপেক্ষায়। প্রথমে নামলেন কাজি। তার পিছনে যিনি, তার মুখ পাণ্ডুর। চাঁদের আলোয় তার মুখাবয়ব সুস্পষ্ট। সামান্য দাড়িতে গালের কাঠিন্য ঢাকা পড়েনি। শীর্ণ মুখের উন্নত নাসিকার পাশে দুটি ক্ষুরধার চোখ, কোনও দৃশ্যই যার কাছ থেকে গোপন থাকে না। পরিধানে তার ধপধপে সাদা সালোয়ার আর কুর্তা। মাথার উষ্ণীষও সাদা। তাতে একটি মাত্র হীরকখণ্ড আটকানো। তিনি হিন্দুস্তানের নব অভিষিক্ত পাদশাহ আলমগির- মইনিদ্দুন মহম্মদ আওরঙ্গজেব। 

ক্ষিপ্র পায়ে নৌকায় লাফ দিলেন পাদশাহ। তার পিছনে চলেছেন হাকিম। মাঝিরা নৌকোর নোঙর খুলে দিতে শুধু যমুনার জলে দাঁড় টানার ছপছপ শব্দ। তিনজন রাজপুরুষের মুখে একটি কথা নেই। নৌকা চলল অপর পাড়ে— সেলিমগড় দুর্গে। 

সেলিমগড়ে এখন রাজবংশের লোকে থাকে না। বিদ্রোহীদের বন্দী করে নির্যাতন করার জন্য এই দুর্গ ব্যবহার হয়। গড়ের এক নিভৃত অন্ধকূপে সারা শরীরে দগদগে ঘায়ের যন্ত্রণা নিয়ে ছটফট করছেন হিন্দুস্তানের প্রাক্তন শাহজাদা দারাশিকো। 

মশালের আলো চোখে পড়তেই অন্ধকারে উঠে বসার চেষ্টা করলেন দারা। আওরঙ্গজেব তাকে তিনবার কুর্নিশ করে বলে উঠলেন, “এখন কেমন বোধ করছেন বড়ে ভাইসাহাব... শাহজাদা দারাশিকো, আব্বা হুজুরের চোখের মণি...?”

“রসিকতা করো না মইনুদ্দিন! সারা শরীরে আমার জ্বালা। বড় বড় ফোস্কা পড়ে গেছে তীব্র গরমে। তেষ্টায় আমার গলা ফেটে যাচ্ছে। আমার যা কিছু আছে সব কেড়ে নিয়ে আমাকে মুক্তি দাও। এই মসনদ আমার চাই না। আমি আল্লার কাছে নিবেদিত। তোমার ওই কোমরে বাঁধা তলোয়ার দিয়ে আমার মুণ্ডচ্ছেদ করো। শুধু একটাই অনুরোধ— আমার পুত্রকে তুমি ছেড়ে দাও। সে আমার হুকুমে তোমার বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। নেহাতই নাবালক সুলেইমন।” 

মৃদুভাষী আওরঙ্গজেব সামান্য শুকনো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, “বড়ে ভাইসাহাব, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। এত বছর ধরে শুধু শহরে-জঙ্গলে যুদ্ধ করে আমি কী পেলাম বলতে পারেন? সামান্য সম্মানটুকুও কি আমার প্রাপ্য নয়? যতবার আগ্রা আর দিল্লির কেল্লায় একের পর এক জঙ্গ ফতেহ করে ফিরে এসে রাশিরাশি সোনাদানা আর মোহর আব্বাহুজুরের পায়ের তলায় ফেলে দিয়েছি, ততবার তিনি আরও সম্পদ কেন লুঠ করে আনিনি— এই অনুযোগে আমাকে ভৎর্সনা করেছেন। আপনিও... না না, শুধু আপনি কেন... কেউ আমার পক্ষ নিয়ে বলেনি— ওকে একটু বিশ্রাম দাও। যা সম্পদ এসেছে তাই যথেষ্ট।” 

“তোমার যুদ্ধ করার কৌশল নিয়ে আব্বা হুজুরের গর্ব ছিল, সে কথা জানো না? তিনিই তোমার নাম রেখেছিলেন- আওরঙ্গজেব। যে শব্দের অর্থ—সিংহাসনের উজ্জ্বল মণি!”

“হাঃ, গর্ব! তার যত গর্বের জায়গা ছিলেন আপনি। আমি কিন্তু বিলাস ব্যসন চাইনি ভাইসাহাব! শুধু মোগল সিংহাসনকে সুরক্ষিত রাখাই ছিল আমার একমাত্র ধ্যান আর জ্ঞান। রাজকোষের সব সম্পদ কী শুধু বড় বড় ইমারত তৈরি করে শেষ করে দিতে হবে? বড় পুত্র হিসাবে একবারও আব্বা হুজুরের সামনে সেকথা তুলে ধরেছেন কখনো? না, করেননি। তখন  আপনি মেতেছিলেন একগাদা সুফি সন্তের দরগায় শায়েরি আওড়াতে। ওই কি যেন নাম লোকটার ... হ্যাঁ মনে পড়েছে সারামদ। ওই নাঙ্গা লোকটার চেলা হয়ে গিয়েছেন। যত রাজ্যের ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পুষছেন রাজ তহবিলের টাকায়। কেন? না আপনি উপনিষদের ফার্সি অনুবাদ করবেন। শুনুন বড়ে ভাইসাহাব, আল্লাতালার আভিপ্রায় নয় যে বেদ উপনিষদের জ্ঞান ইসলাম দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিতে হবে...”

“শোন মইনুদ্দিন, আল্লা মানুষে মানুষে বিভেদ পছন্দ করেন না। মানুষকে ভালবাসলে তবেই তুমি আল্লার কাছে পৌঁছতে পারবে”

দারাকে এবার ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন পাদশাহ আলমগির।

“থামুন আপনি! ওই সুফি মত আমাকে শোনাবেন না। যদি সব মানুষে আপনার ভালবাসার অমৃত সিঞ্চিত হয়, তবে যুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন কেন? কেন রাজকোষের অহেতুক অর্থব্যয় আপনাকে বিচলিত করে না? আপনার সুফি গুরু ওই আর্মেনিয়ান সারামদ উলঙ্গ হয়ে শাহজাহানাবাদের রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে, আর আপনি ছোটেন তার পিছন পিছন...। যাক, রাত কেটে যেতে আর দেরি নেই। ভাইসাহাব, আমাকে একটা কথা বলুন তো – আপনি যদি আমার জায়গায় হতেন আর আমি আপনার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতাম, তবে আপনি বিচারে আমার কী শাস্তি বিধান দিতেন?”

শৃঙ্খলে বাঁধা হাত দুটো শূন্যে ঘুরিয়ে দারাশিকো কঠিন গলায় বললেন, “তোমার দেহ চারটে টুকরো করে শহরের চারটে প্রধান দরজায় টাঙিয়ে দিতাম।”

দারার কথায় অন্ধকার ঘরে মশালও যেন কেঁপে উঠল। অনেকক্ষণ পর আওরঙ্গজেব কাজির দিকে দৃষ্টিপাত করে জিজ্ঞেস করলেন, “কাজি সাহেব, আপনারও কি তাই মত?”

“আমি হিন্দুস্তানের শাহেনশাহর গোলাম। রাজপুরুষদের বিচার করার আমি কে? আল্লার নিয়োগ করা প্রতিনিধির মতের বিরুদ্ধে গেলে তিনি আমাকে ক্ষমা করবেন না। আমাকে এই বিচার থেকে অব্যহতি দিন শাহেনশাহ।”

আওরঙ্গজেব আর কথা না বাড়িয়ে ক্ষিপ্র পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কাজি ও হাকিম তাকে অনুসরণ করল। দারা উপহাসের গলায় হাকিমকে বিদ্রুপ করে বললেন, “হাকিম সাহেব আজ কার চিকিৎসা করতে এসেছিলেন? যান যান, আপনার শাহেনশাহর মাথার চিকিৎসা করুন গিয়ে। আমার ক্ষত সারাবে আল্লাহুজুর। হাকিমে আমার কী প্রয়োজন?”


দিওয়ান-ই-আম-এ আজ দাঁড়াবার জায়গা নেই। শাহেনশাহ আওরঙ্গজেবের দরবারে ডাক পড়েছে যত সেনাপতি, আমির ওমরাহের। পাদশাহ এখুনি এসে বসবেন কোহিনূর সিংহাসনে। অভিষিক্ত হবার পর এই প্রথম তিনি সিংহাসনে বসে দরবার চালাবেন। কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে শাহজাদা দারার মৃত্যুর কথা। কেউ বিশ্বাস করছে, কেউ করছে না। শাহি খানদানের অলিন্দে কত কী যে ঘটে যায়, কতটাই বা তা জনসমক্ষে আসে! তবে এমন কিছু একটা ঘটবে, তার আন্দাজ বা আভাস সবার ছিল। প্রায় বছর খানেক ধরে শাহেনশাহ শাহজাহান অসুস্থ্য। মাত্র একবারের জন্য ঝরোখা দর্শনে এসেছিলেন। তারপর থেকে শুধু যুদ্ধের নানা রঙিন খবর শাহজাহানাবাদের অলিতে গলিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। হিন্দুস্তানের অন্য জায়গার খবর এই শহরে সবটা পৌঁছয় না। শহরের মানুষ সুখে শান্তিতে, পায়রা উড়িয়ে, অলস সময় কাটিয়ে দিব্যি আছে। কিন্তু মসনদের এই পরিবর্তন তাদের জীবনযাত্রা বদলে দিতে পারে। তাই আজ আমির ওমরাহের পাশে শহরের শ্রেষ্ঠী আর বনিক সমাজের প্রতিনিধিরাও হাজির। 

লাহোরী দরজার দিকে প্রহরীদের সতর্কবাণী শোনা গেল। অশ্বারোহী সৈন্যের দল ধীরে ধীরে ছাত্তা বাজার পার করে দিওয়ান-ই-আমের দিকে এগোতে লাগল। উপস্থিত সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইল সেই দিকে। বিশাল এক সোনার পাত্র হাতে নিয়ে পদাতিক এক সৈন্য দরবারের দিকে এগিয়ে আসছে। তার পিছনে খোলা তরোয়াল হাতে দশজন অশ্বারোহী। নগর কোতোয়ালের হাতের ইশারায় দলটি থেমে গেল। তখনি ঘোষকের কণ্ঠে শোনা গেল- সবাই সাবধান, হিন্দুস্তানের অধীশ্বর, পরমেশ্বরের প্রতিনিধি শাহেনশাহ-ই-আলম, মইনুদ্দিন মহম্মদ আওরঙ্গজেব, পাদশাহ আলমগির দরবারে আসছেন।

আজও আলমগিরের পরনে সাদা পোশাক, কিন্তু মাথায় তার রাজমুকুট জ্বলজ্বল করছে। পাদশাহকে দেখে সভায় উপস্থিত সমস্ত মানুষ কোমর ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ জানায়। নক্করখানা থেকে শাহি বাজনা বেজে ওঠে। 

কোহিনূর সিংহাসনে বসেই আওরঙ্গজেব বাজনা বন্ধ করতে নির্দেশ দিলেন। তার মুখের বিরক্তি আর ক্রুরতার অভিব্যাক্তি নজর এড়ায় না কারো। 

যে সৈন্যটি সোনার থালায় লাল মসলিনের কাপড়ে মুড়ে পাদশাহের জন্য কোনও বহুমূল্য দ্রব্য বয়ে এনেছিল স-সম্মানে, সেই থালাটি পাদশাহের সামনে এবার আনা হল। থালার আবরণ সরিয়ে দিতেই ভয়ে শিউরে উঠে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল সভাসদেরা। থালার উপর শাহজাদা দারাশিকোর ছিন্ন মুণ্ডু। 

ঘোষক গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করল— রাজদ্রোহের অপরাধে পূর্বতন সম্রাট শাহজাহানের প্রথম পুত্র দারাশিকোকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। রাজদ্রোহের শাস্তি এই। যারা তাকে সাহায্য করেছে, তাদের সবাইকে শাহেনশাহ আওরঙ্গজেব ক্ষমা করে দিয়েছেন। তাদের রাজকাজে পুনর্বহাল করা হল। কিন্তু সম্পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করা বাধ্যতামূলক। 

শাহেনশাহ আওরঙ্গজেব নিজের চোখে দারার কাটা মুণ্ডু দেখলেন। তার মুখ আরও কঠিন হয়ে উঠল। তারপর তিনি প্রধান উজিরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “দারাশিকোর দেহ যেন হুমায়ূন মকবরার পাশেই সমাধি দেওয়া হয়। কিন্তু তার গর্বিত শির ঝুলবে কাবুল দরওয়াজার উচ্চ খিলানে। রাজধর্ম ভ্রষ্ট হওয়ার জন্য দায়ী ওই মাথাটাই। দারাশিকোর সন্তান সুলেইমনকে ছেড়ে দেওয়া হোক। সে আমার সন্তান সম। রাজসিংহাসনে আসীন আল্লার প্রতিনিধি সম্রাটের একমাত্র কর্তব্য পয়গম্বরের আদেশ পালন করা। কিন্তু কোনও সুফি সাধক বা ভিন্ন ধর্মের মানুষের সাথে মোগল শাসনের বিন্দুমাত্র বিরোধ নেই।”

রাজাদেশ দিয়ে আওরঙ্গজেব উঠে দাঁড়ালেন। সভার মানুষ আবার তাকে তিনবার কুর্নিশ করল। হিন্দুস্তানের সম্রাটের চোখের কোণ ভিজে উঠল, সে দৃশ্য কারো নজরে পড়ল না।  

No comments