DEHLIJ

নির্মিতা

ম্যাক্লাস্কি, এক অবিস্মৃত অতীত




কত রাত্রির খসে পড়া পাতা-পোশাক, খোঁপায় জড়ানো ফুল। কোকিল ডাকা হলুদ বিকেল। খয়েরী শালপাতায় হেঁটে যাওয়া শব্দে পড়ন্ত যৌবনের মাদকতা। দামী সিঙ্গেল মল্টের থেকে অনাদরের মহুয়ার কদর বেশি। এইবার বুঝেছি কেন কথায় বলে, মহুয়ার গন্ধেই ভাল্লুকের নেশা হয়!

রাঁচি থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তরপশ্চিমে অবস্থিত ছোট্ট পাহাড়ী ব্রিটিশ শহর ম্যাক্লাস্কিগঞ্জ। ১৯৩২ সালে ঝাড়খন্ডের রাতু এস্টেটের মহারাজার কাছ থেকে প্রায় ১০,০০০ একর জমির লীজ নেন কলকাতার প্রতিষ্ঠিত অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান ব্যবসায়ী আর্নেস্ট টিমোথি ম্যাকলাস্কি। তারপর, ১৯৩৩-এ স্থাপিত কলোনাইজেশন সোসাইটি অফ ইণ্ডিয়া মারফত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৪০০ অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান পরিবারকে এখানে এসে বসতি স্থাপন করার আহ্বান জানানো হয়। গড়ে ওঠে ‘অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান হোমল্যান্ড’ – তারই নামাঙ্কিত জনপদ,  ম্যাক্লাস্কিগঞ্জ। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবং ভারতের স্বাধীনতার প্রাক্কালেই বদলে যেতে থাকে এই জনপদের চেনা ছবি। অধিকাংশ পরিবার ফিরে যায় ইংল্যান্ড, থেকে যায় নামমাত্র ২০-৩০টি পরিবার। সময়ের সাথে পড়ে থাকে স্মৃতি, বসতবাড়ি, ঔপনিবেশিকতার আভিজাত্য। সেদিনের ছেড়ে যাওয়া ঔপনিবেশিক বাংলো আজকের হেরিটেজ হোমস্টে। ম্যাক্লাস্কিগঞ্জ আজ আর শহর নয়। নগরায়ণের ছন্দ নেই, তবে আবাসিক স্কুল, গির্জা, সাহেব কুঠির চালা, আগছা গড়িয়ে ওঠা বন্ধ গেটে ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের মেজাজ অমলিন। লাল-সবুজ সিগন্যালের মাঝে বয়ে যায় স্টেশনমাস্টারের সাপ্তাহিক অপেক্ষা। ইতিহাস মিশে থাকে দেওয়ালে, পথে, আদিবাসীদের পাড়ায়। 

তারপর হঠাৎ গোধূলি শালবনে, আলগোছে আঙুল রাখে। গত রাত্রির খসে পড়া পোশাকে তখনো মিলনের গন্ধ। নিষিদ্ধ প্রেমের আজ রাতের ঠিকানা হয়তো ডোগাডুগির পার। আমরাও হাঁটলাম দিগন্তরেখা ধরে, শব্দ ছেড়ে ছেড়ে ডুবে যাবার আগে। এরপর এক শরীর কলঙ্ক নিয়ে দোলের চাঁদ অধৌত রেখে গিয়েছিল ম্যাক্লাস্কির শৈশব। 

রূপকথার সেই রাত। জ্যোৎস্না অবগাহন। রানাস কান্ট্রি কটেজের পাঁচিলের এপার-ওপারেই অরণ্যের দিনরাত্রি। প্রত্যেক ৬০-এ চারটে আইস কিউব বিলাসিতা, কিন্তু ওতেই গাঢ় হচ্ছে প্রেসক্লাবের কর্নার টেবিলে বহু সন্ধ্যের বুঁদ হয়ে থাকা। বাইরে হাসির রোল, ফিসফাস, বারণ-না-মানা কৌতূহলকে ছাপিয়ে যায় ঘরের ভেতরের চার আঙুলের খুনসুটি। সস্তার গোল্ড ফ্লেকে কাউন্টার বাঁধন ছাড়া জীবনের প্রতিশ্রুতি, টিক-অফ দ্য বাকেট লিস্ট। চোখে চুলে আলো এসে পরে। এক জীবনে তখনো অগোছালো ঘোর। অন্য জীবনে ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে মহুয়ার খোঁজ, যাপন ও জীবিকায়।       

রানাস কান্ট্রি কটেজের মহুল বন সকালের কৈশোর নিয়ে হাজির। নাগরিক ক্লান্তিতে একটা ভ্যাকসিন ভোর। সবুজ সভ্যতায় বহুদূর হেঁটে এসেছিলাম, আঙুলের নিকোটিন গন্ধ রাত পোহাবার আগেই বাতাসে মিলিয়েছিল। কত আর্গুমেন্ট-কাউন্টার আর্গুমেন্টের মাঝে অচেনা ছুটি অমীমাংসিত থেকে গেল। ব্রাহ্মে, মন্দার, বিজুপাড়া পেরোতে পেরোতে যে পাহাড়ী পথে বলে-কয়ে কথা দিয়েছিলে ‘তোমায় মহুয়া খাওয়াবো’, সেই হাওয়া সফর বহু জন্মের অনাবিষ্কৃত ভালোলাগা। হালকা হলুদ ঝরা শাল দিয়ে নয়, ফাগুন দিয়ে ম্যাক্লাস্কি যে সকাল সাজিয়েছিল – সেখানেই তোমার হাতে প্রথম মহুয়া পরিচয়। যে কুড়িয়ে পাওয়া স্বাদ আমার কাছে ভ্রমণবিলাসিতার অঙ্গমাত্র আর প্রিভিলেজড ফ্যান্টাসি, তাই শ্রেণিদ্বন্দ্বে পিছিয়ে থাকা মানুষগুলোর অন্নসংস্থানের বনজ আহরণ। হয় তাকে রোদে শুকিয়ে, তারপর জাল দিয়ে সেই রস বিক্রি হবে, নয়তো রোদে শুকোনো মহুয়াই হবে স্থানীয় বাজারে পসরা। সাবস্ট্যান্স অ্যাবিউস জাতীয় আর্মচেয়ারমূলক জ্ঞান ঠাণ্ডা ঘরে বিদেশী ফান্ডিং-এ চলা কনফারেন্সেই শোভা পায়, লড়াকু মানুষগুলোর জীবনে নয় , যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় …

এ যেন রঙজন্মের অপ্রকাশিত আদর। যে ধূসর খুঁজতে চেয়ে মেখে এসেছি বহু নামহীন উষ্ণতা, যে নীল খুঁজতে চেয়ে গভীর হয়েছে নৈঃশ্যব্দ, যে কালো আমার অভিমান – ম্যাক্লাস্কির বসন্ত উপত্যকা সেইসব নির্বাক বোঝাপড়ায় কনফেশন। শাল জঙ্গলের ওই অনুরণন, শুক্লপক্ষের বৃষ্টিহীন ভিজে থাকা, আমার অকিঞ্চিৎকর আবদারে তোমার প্রতীক্ষিত মুক্তি দীর্ঘজীবি হোক। জারি থাকুক সবুজ বিপ্লব, লাভ অ্যান্ড হেট কেমিস্ট্রি। 






এই সবুজাভ কটেজাবাস ছুঁয়ে থাকা অতীতের প্রেক্ষাপট। ব্রিটিশ-ইণ্ডিয়ান রেলওয়েতে কর্মরত অফিসার মিস্টার ওয়েস্টার ১৯৩৬ সালে তৈরি করেছিলেন এই বাংলো। পরবর্তীতে, ১৯৬২ সালে তিনি নেপাল রাজপরিবারের উত্তরসূরী রানা পরিবারের কাছে বাংলো বিক্রি করে পাড়ি দেন কানাডায়। হস্তান্তর, তারপর দেশান্তর - সময়যানে ইতিহাস ঘনীভূত হয়। স্বর্গীয় কর্নেল রানা বিলায়েত জং বাহাদুর বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন ত্রিপুরা রাজপরিবারে কন্যা কাঞ্চন প্রভা দেবীর সঙ্গে। বর্তমানে এই বাংলো রাণী কাঞ্চন প্রভা দেবীর মালিকানাধীন, পরিচালনার দায়িত্বে  বিলায়েত জং বাহাদুর এবং কাঞ্চন প্রভা দেবীর পুত্র রানা দীপক জং বাহাদুর। রানা দীপকের তত্ত্বাবধানে এই বাংলো নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ হয় এবং ২০১৬ সাল থেকে তা অতিথিগৃহ হিসেবে চালু করা হয়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নানাবিধ ন্যারেটিভের ভিড়ে ধূসর হতে হতে ‘অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান হোমল্যান্ড’-এর  নিরন্তর রেশটুকু থেকে যায় নিরাভরন ঐতিহ্য নিয়ে।  

জমে থাকা ধুলোর আস্তরনে উস্কে দেওয়া স্মৃতি ম্যাক্লাস্কির এই কান্ট্রি কটেজ। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের প্রলেপে এক অবারিত শৈল্পিক অনুভূতি। ইংলিশ কান্ট্রি হোমের আদল, মৃৎশিল্পকলা, নেপালী ও নানাবিধ আর্টিফ্যাক্টস্‌-এর সাজ - সব মিলিয়ে এক অনাবিল অ্যাস্থেটিক প্লেসার। “লাইফ ইজ ওল্ড দেয়ার, ওল্ডার দ্যান দ্য ট্রি, ইয়াংগার দ্য মাউন্টেনস্‌, গ্রোয়িং লাইক আ ব্রিজ”. . . . . ধোঁয়া ওঠা কফিতে চুমুক, স্পর্শময় সকাল, মনের খড়কুটো আর আকাশচোর না হতে পারার দুঃখবিলাসিতা।

 এসব মর্নিং মিউসিংজের মাঝে অনিচ্ছাকৃত ঘরে ফেরার ডাক। দু-চাকার সফর সঙ্গী চেপে দুপুরের রুক্ষ রোদে কোমল পাতাবাহার পেরিয়ে আরো এক জীবনবোধকে ছুঁয়ে যাওয়া। যখন কিছু অশিক্ষিত, মৌলবাদী, স্বৈরাচারী গোঁড়া, ধর্মান্ধ আপদ (হ্যাঁ, সেই সকল আপদ এবং বিপদ - যারা হিন্দুত্বের কিস্যু জানে না!) গো-মাতা অবসেশনে ভুগছে, গরুর দুধে সোনার মতো যুগান্তকারী আবিষ্কার করে ফেলেছে; কিংবা দেশে করোনা সংক্রমণের গতি রোধের ‘সুস্বার্থে’ অক্সিজেন সাপ্লাই বাড়াবার জন্য আরো বেশি সংখ্যক গোশালা স্থাপনের জল্পনা করছে – তখন ম্যাক্লাস্কির কাছে দুল্লী গ্রামের সর্বধর্মস্থল এক ব্যতিক্রমী আহ্বান। একই পরিসরে মন্দির-মসজিদ-গুরুদ্বারা এবং গির্জা তৈরীর জন্য রাখা নির্ধারিত স্থান ! মন্দির-মসজিদ তৈরী হলেও ইন্সারজেন্সির কারণে শেষ করা যায়নি গুরুদ্বারা এবং গির্জার কাজ। কিন্তু নির্দিষ্ট একজন সেবাইত পুজোর দায়িত্বে যিনি মন্দির, মসজিদ, গুরুদ্বারা – এই তিনটি স্থানেই নিত্যসেবা করে থাকেন। মন্দিরে রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ বর্তমান। ধর্মধ্বজাধারী অন্ধজনের কাছে দুল্লী এক সেকুলার দৃষ্টান্ত, মানবতার শত্রুদের কাছে অরিন্দম শক্তির প্রেরণা।  

অতীত কথা বলে। “পাস্ট ইজ নেভার ডেড। ইটস্‌ নট ইভেন পাস্ট”, লিখেছিলেন নোবেল লরিয়েট উইলিইয়াম ফলক্‌নার। ম্যাক্লাস্কি তেমনি বহমান সংলাপ। অমিতব্যয়ী জীবনের অক্সিজেন। ছকে বাঁধা যুম-কথার ভিড়ে অবশ্যম্ভাবী ঘর ছাড়ার ডাক। 


1 comment:

  1. অন্য সব লেখার মত তোমার এই ব্লগটিও চমৎকার। আরও এরকম সাহিত্যগুণ সমৃদ্ধ লেখা তোমার কাছে আশা করি।

    ReplyDelete