DEHLIJ

নাহিদা আশরাফী

বিশ শতকের বাংলা কবিতায় আধুনিকতা



পাঁজি মিলিয়ে মডার্নের  সীমানা নির্ণয়  করবে কে? এটা কালের কথা ততটা নয় যতটা ভাবের কথা। নদী সামনের দিকে সোজা চলতে চলতে হঠাৎ বাঁক ফেরে। সাহিত্যও তেমনি বরাবর সিধে চলে না। যখন সে বাঁক নেয় , তখন সেই বাঁকটিকেই বলতে হবে মডার্ন। বাংলায় বলা যায় আধুনিক। এই আধুনিকতা সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে।

রবীন্দ্রনাথ তার আধুনিক কাব্য প্রবন্ধের গোড়াতেই  মূল কথাটি বলে দিয়েছেন বলা যায়। সমকালে আধুনিকতার সংজ্ঞা কী, তার লক্ষনই বা কী? কী রূপে নির্ধারিত হবে আধুনিকতার  স্বরূপ? প্রশ্ন অনেক কিন্তু উত্তর? আধুনিকতার প্রশ্নে যে উত্তর সর্বদাই পরিবর্তিত , পরিমার্জিত, পরিবর্ধিত এবং পরিশোধিত হতে থাকে। আধুনিক কবি কে? সময়ের  থেকে যিনি এগিয়ে থাকেন ,নাকি সময়কে যিনি যথাযথ ধারণ  করেন। আধুনিক কবিতার বেলাতেও একই প্রশ্ন। সেই হিসাবে রবীন্দ্রনাথ সর্বাধুনিক কবি। জীবনানন্দ  সময়েরও অধিক আধুনিক কবি।   

মূলত আধুনিক শব্দটি আপেক্ষিকতা দাবী করে। বিশ শতকের কবিতায় আধুনিকতা নিয়ে যারা এসেছিলেন তাদের মধ্যে নজরুল  যেমন আধুনিক তেমনি প্রশ্ন আসে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু কে আধুনিক নন? বিশ্ব সাহিত্যেও  একই  রকমভাবে  চিহ্নিত করা যায় বহু সংখ্যক কবি ও তাদের  কবিতাকে। আমরা বরং চলুন বিশ শতকের কবিদের মুখে শুনি তারা আধুনিকতা নিয়ে কী ভেবেছিলেন , আধুনিকতাকে  কীভাবে দেখেছিলেন।  

বুদ্ধদেব বসু আধুনিক কবিকে দেখেছেন “প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র এবং স্বতন্ত্রভাবে নতুন” তিনি  তার  আধুনিক বাংলা কবিতায় উপস্থাপন করেছেন বিচিত্র কবিতা ধারা যেখানে বলা হয়েছে আধুনিক কবিতার প্রবাহে মিশে আছে বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, সংশয়, ক্লান্তি, সন্ধান, বিস্ময়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ, বিশ্ব প্রকৃতির প্রতি আস্থা। তার  বক্তব্য টেনেই যদি বলি- “আশা আর নৈরাশ্য, অন্তর্মুখিতা ও বহির্মুখিতা, সামাজিক জীবনের সংগ্রাম ও অধ্যাত্মিক জীবনের তৃষ্ণা,  এই সবগুলো ধারাই খুঁজে পাওয়া যাবে,  শুধু ভিন্ন ভিন্ন কবিতে নয়, কখনো হয়তো  বিভিন্ন  সময়ে একই কবির রচনায়।“ –( আধুনিক বাংলা কবিতা সংকলন )

তিনি  উনিশ – শতকী রোমান্টিক আন্দোলনের পরস্পর বিরোধী সংজ্ঞার্থের  উদাহরণ  টেনে দেখিয়েছেন প্রতিভাবান একজন কবির মাধ্যই যদি আত্মবিরোধ সম্ভব হয় তবে যুগ বা শতকের সৃষ্টিতে  বিবিধ স্রোত বহমান রবে এটাই তো স্বাভাবিক। সাহিত্য যদি  চিত্তের  নির্যাস বা হৃদয়ের মহিমা হয় তবে আধুনিকতা সেই  নির্যাসে বা মহিমায় তুলির এক আঁচড় মাত্র। একথা মানতে হবে যে সময়ের  দিক থেকে আধুনিকতা  ধারণ করলেই তাকে আমি বা আমরা আধুনিক কবিতা বলতে পারি না। একই সময়ে একই সমাজে থেকেও কী প্রতিটি চিন্তা, দর্শন, যাপিত জীবন, রাজনৈতিক দর্শন পরস্পরের থেকে ভিন্ন নয়?  

এ প্রসঙ্গে আবার জীবনানন্দে ফিরে যাই  -

“বাংলা কাব্যে বা কোনো দেশেরই বিশিষ্ট কাব্যে আধুনিকতা শুধু আজকের কবিতায় আছে – অন্যত্র নয় – একথা ঠিক নয়।“ – (কবিতার কথা। )

অতএব একটা  ব্যাপারে আমরা সুনিশ্চিত যে বাংলা কবিতায় ,  অবশ্য বাংলা কবিতা নয় বিশ্ব কবিতার আধুনিকতাও কোনো সময় দ্বারা সুনিশ্চিত নয়। তবু যেহেতু আজ বিশ শতকের বাংলা কবিতা নিয়ে কথা বলতে চাইছি সে ক্ষেত্রে এই শতকের  কবিতায় আধুনিকায়নের লক্ষণ, প্রসঙ্গ ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে দু’চারটি কথা বলা যেতেই পারে।

কবিতা মানে বিশ শতকের কবিতায় কোন কোন ঘটনাপ্রবাহ বিশেষ প্রভাব ফেলেছে সেটা আগে একটু ব্যাখ্যা করবার প্রয়োজন বোধ করছি। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে প্রথম মহাযুদ্ধ,  সমাজতান্ত্রিক  রুশ বিপ্লব , দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাংলা সাহিত্যের শুধু কবিতায় নয়, আমি বলবো সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় এমন এক বাঁক বদলের কারণ  হয়ে  দাঁড়ায় যে বাংলা কবিতা নবপর্বে প্রবেশের পদচ্ছাপ  আমরা সেখান থেকেই দেখতে পারি। দুই মহাযুদ্ধ এক বিশাল  বিপুল  ছাপ ফেলে যায় আমাদের  জীবনে, যাপনে, চিন্তায়, ব্যক্তিত্বে বোধ ও মননে। এক বিপন্ন মানচিত্রে দাঁড়িয়ে সাহিত্যকে নতুন করে উপস্থাপনের এর  শাশ্বত ভাবধারাকে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরবার প্রয়োজন বোধ করলেন আমাদের কবিরা।

এমনিতেই উনিশ শতকের মধ্যভাগের সাহিত্যে যে রোমান্টিক ভাবধারা ছিলো , থিওরি অফ ইভেলুশন  বা বিবর্তনবাদ তাতে  বেশ জোরেই  এক আঘাত দিয়েছিলো। একদিকে হোলা, ইবসেন প্রমুখের রচনায় প্রকৃতিবাদ, অন্যদিকে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মানস প্রক্রিয়ার  ত্রিস্তরের  উপস্থাপন। ফলত চেতনার গভীরে এক আত্মমুখী প্রবণতা ফ্রয়েড এমনভাবে তুলে ধরলেন যা দ্বারা মানবমনের অহং বা অবচেতনের মহিমা আধুনিক কবিতাকে আর আধুনিক ও subjective করে তুললো।

বিশ শতকে পা দেবার আগেই আমরা পেলাম শার্ল বোদলেয়ারের ‘ লে ফ্ল্যর-দ্যু–মাল’ যাকে আধুনিক কবিতার আদি উৎস বলা যেতে পারে। তার আগেও এডগার অ্যালান পো , ইয়েটস, রিলকে মালার্‌মে লোরকা, অনেক কবির কবিতাতেই আমার আধুনিকতার সৌকর্য ও সৌন্দর্য খুঁজে পাই। আধুনিক বাংলা কবিতায় এই ইউরোপীয় ও পাশ্চাত্য প্রভাব বেশ  অনেকটাই বলা যেতে পারে ।

কিন্তু বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার প্রভাবটি লক্ষণীয় মোটামুটি ভাবে তৃতীয় দশক থেকে। মূলত এই সময় থেকে বাংলা কবিতায় যে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় তা মূলত আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক পট পরিবর্তনেরই এক ধারাবাহিকতা মাত্র। বাংলা সাহিত্যের ‘কল্লোল’ (১৯২৩), ‘কালিকলম ‘ (১৯২৬), পরিচয় (১৯৩১) কবিতাসহ বিভিন্ন পত্রিকা বাংলা কবিতাকে,  কবিতার মেজাজকে এক নবরূপে উম্মোচনে বিশেষ অবদান রেখেছে। আমরা পেয়েছি অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত , জীবনানন্দ দাশ থেকে ‘খসড়া’ , ‘উর্বশীও আর্টেমিস’,  ‘অর্কেস্ট্রা’  বা ‘ধুসর পাণ্ডুলিপি’র মত সৃষ্টিকর্ম।

বিশ শতকে  বাংলাদেশের কবিতায় আধুনিকতা বুঝতে হলে বা এর মৌল প্রবণতা সম্পর্কে কিছু ধারণা  যদি আমরা পেতে চাই সেক্ষেত্রে এটাতে যদি আমরা তিন পর্বে ভাগ করে নেই তাহলে কথা বলতে সুবিধা হবে।

প্রথমত ১৯৪৭-৫৭ , দ্বিতীয় পর্বে ৫৮ থেকে ৭০ এবং তৃতীয় ৭১ পরবর্তী পর্ব ।


প্রথম পর্ব-

প্রথমপর্ব যেটা ধরা যায় দেশভাগ পরবর্তী সময়। এসময় দেশভাগের  নানান  জটিলাবর্তে  অর্থনৈতিক দুরবস্থা, উদ্বাস্তু সংকট, সাম্প্রদায়িক সমস্যা একে একে সামনে এলে সাধারণের যে বিভ্রান্তি আর ধর্ম ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার যে বিকলাঙ্গ ও বর্বর রূপ  সামনে পরে তাতে তাদের আর বুঝতে বাকি থাকে না যে ধর্মের গোঁড়ামি আর যাঁতাকল থেকে ভাষাও মুক্তি পাচ্ছে না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই চলে আসে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন। ফলশ্রুতিতে ফররুখ আহমেদ, আহসান হাবিব অথবা সৈয়দ আলী আহসানের ধর্মীয়  রোমান্টিক ভাবাম্পন্ন  কবিতার পরিবর্তে সাধারণ  বাঙালির মাটি, মানুষ, ভাষা ও প্রকৃতি নিয়ে মানবতাবাদী কবিতার প্রতি ঝোঁক বাড়ে। যার হাত ধরে আমরা পাই আশরাফ সিদ্দিকীর  বিষকন্যা (১৯৫৫), উত্তর আকাশের তারা (১৯৫৮), মাজহারুল ইসলামের মাটির ফসল, বেগম সুফিয়া কামালের মন ও জীবন (১৯৫৭) সহ আরো কিছু উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি । কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এই একটু অন্য ধারার কবিতাই আধুনিকতার পোষাকে আরো উজ্জ্বল ও প্রাঞ্জল হয়ে ধরা দেয় শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন  আল  আজাদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রমুখের কবিতায়। ১৯৫০ এ আশরাফ সিদ্দিকি ও আব্দুর রশিদ খানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘নতুন কবিতা’। এছাড়া ১৯৫৩ তে হাসান হাফিজুর রহমান ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ নামে আরকটি সংকলন প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের কবিতায় অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী আধুনিক কবিতার চরিত্র বিশ্লেষণে  এই দুটি সংকলন  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো।   

মহান একুশে নিয়ে আলাউদ্দিন  আল  আজাদের  কয়েকটি পংক্তি  আপনাদের শোনাতে চাই-

“স্মৃতির  মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু,আমরা এখনো চারকোটি পরিবার/ খাড়া রয়েছি তো। যে ভিত  কখনো কোনো রাজন্য পারেনি ভাঙতে।/ হীরের মুকুট নিল পরোয়ানা, খোলা তলোয়ার/  খুড়ের ঝ্টিকা ধুলায় চূর্ণ যে পদ–প্রান্তে / যারা বুনি ধান /  গুন টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাপড় চালাই / সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য ।/ ইটের মিনার / ভেঙেছে ভাঙুক! ভয় কি বন্ধু? দেখো একবার আমরা জাগরী চারকোটি পরিবার।/“


দ্বিতীয় পর্ব-

দ্বিতীয় পর্বের শুরুটাই সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে। রাজনৈতিক দোদুল্যমানতা ও অস্থিরতা বরাবরই কবিতায় তথা সাহিত্যে প্রভাব ফেলেছে। এখানেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। গণতন্ত্রের  খোলসে একনায়কতন্ত্রের ভয়াবহতা এক সময় গন আন্দোলনের রূপ নেয়। ‘৬৮ এর গন অভ্যুত্থান, ‘৬৯ এর ছাত্রদের ১১ দফা দাবি আদায়ে  লক্ষ্যে  দাবীদিবস পালন, ৭০ এর  সাধারণ  নির্বাচনে বাঙালিদের নিরঙ্কুশ জয় এবং জয়ী দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করবার ষড়যন্ত্র প্রতিটি ঘটনাই প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের সাহিত্য তথা কবিতায়। এই সময়ে প্রেম প্রকৃতি, রোমান্টিকতায় ভাবোচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ কবিতার পাশাপাশি এই সময়কালীন  রাজনীতি, অস্থিরতা, অবক্ষয় আর  দ্বান্দিক পরিস্থিতিকে তুলে আনা হয়েছে যা আধুনিক কবিতার এক অন্যতম উপাদান  হিসেবে আমরা পেয়েছি। শামসুর  রাহমানের ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ (১৯৬০), ‘রৌদ্র করোটিতে’ (১৯৬৩) এ ধারার দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন, এছাড়া হাসান হাফিজের বিমুখ প্রান্তর (১৯৬৩) , আল মাহমুদের লোক লোকান্তর (১৯৬৩) সহ আরো বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সংযোজন রয়েছে । মোট কথা ব্যক্তিরূপ  ছাড়িয়ে সমষ্টির রূপ ক্রমে ক্রমে উচ্চকিত হতে থাকলো।  কবিতার চিত্রকল্প, ভাবরূপ পাল্টে এক নবতর সুরের জোয়ার লক্ষ করলাম আমরা। সৈয়দ শামসুল হক এর ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’ (১৯৬৯) শামসুর রাহমানের ‘নিজ বাসভূমে’ (১৯৭০) আল মাহামুদের ‘সোনালী কাবিন’ ও নির্মলেন্দু গুণের ‘প্রেমাংসুর রক্ত চাই’ আমাদের এক ভিন্নতর কবিতার  স্বাদ এনে দিলো। সময়োপযোগী শব্দ কবিতায় স্থান  করে  নিলো। লক্ষণীয় যে এই সময়ে কবিরা নিজেরাই নিজেদের প্রতিনিয়ত ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে রেখে কবিতাকে প্রান্তিক মানুষের প্রতিবাদের ভাষা করার মাধ্যমেই তাকে আধুনিকতার র রূপ  দিয়েছেন।   

সোনালী কাবিনে আল মাহমুদের কাব্যভাষা তাঁর পূর্ববর্তী সব কবিতার ভাষাকে ছাড়িয়ে গেলো। ১৪ টি সনেটের ৬,৭,৯,১০ ও ১২ নম্বর সনেটগুলোতে চোখ বোলালেই দেখতে পাই সাম্যবাদী রাজনৈতিক ভাবনাকে  তিনি শিল্পিত অনুষঙ্গে প্রকাশ  করেছেন। উদ্দিষ্ট নারী হয়ে উঠেছে দেশ মাতৃকা রূপে-

‘ধ্রপদের আলাপনে অকস্মাৎ ধরেছি খেউড় / ক্ষমা করো হে অবলা, ক্ষিপ্ত এই কোকিলের গলা ।/ তোমার দুধের বাটি  খেয়ে যাবে সোনার মেকুর / না দেখার ভান করে কতকাল দেখবে , চঞ্চলা? ‘ (সোনালী কাবিন-৯)

অথবা

জ্ঞানের প্রকোষ্ঠে দেখো ঝুলে আছে বিবর্ণ বাদুড়/  অতীতে বিশ্বাস রাখা হে সুশীলা, কেমন দুরহ? (সোনালী কাবিন-৬)

অথবা

আমাদের  কলাকেন্দ্রে, আমাদের সর্ব  কারুকাজে / অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা । (সোনালী কাবিন-১১)

অর্থাৎ যে কবি মায়াবী পর্দা দুলে ওঠার মত ‘আমি’  অস্তিত্ব সর্বস্ব কবিতা লিখেছিলেন  সময় তাকে হাত ধরে দাঁড়  করিয়ে দিয়েছে এমন এক দাণ্ডিক দ্যোতনায় যেখানে দাড়িয়ে তিনি সোনালী কাবিনের মত মাটিলগ্ন কিন্তু আধুনিক কবিতা সম্ভারে  আমাদের ভরিয়ে তুললেন।

একটু ফিরে তাকাই  নির্মলেন্দু গুণের ‘প্রেমাংসুর রক্ত চাই’ এ । যেখানে মানুষ  কবিতায় তিনি লিখলেন-

‘আমি হয়ত মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম, /  হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে  ও-ঘরে যায়, / মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে  কাটলে দৌড়ে  পালায়। /

.......................................................................................................................

মানুষ হলে উরুর মধ্যে দাগ থাকতো, / বাবা থাকতো, বোন থাকতো, / ভালোবাসার লোক থাকতো,/  হঠাৎ করে মরে যাবার ভয় থাকতো।/  

.......................................................................................................................

মানুষগুলো  সাপে  কাটলে দৌড়ে পালায়; /  অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই ,/  অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে  ধরি।/  

যুদ্ধ কবিতায় লিখলেন-

‘যুদ্ধ মানেই শত্রু শত্রু খেলা, /যুদ্ধ মানেই / আমার প্রতি তোমার অবহেলা’।


তৃতীয় পর্ব

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধের নারকীয়তা এবং তাঁর মাধ্যমে এক সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা ও স্বাধীনতা অর্জন সব কিছুই স্থান পেয়েছে ৭১ পরবর্তী কবিতায়, এ সময়ে কবিতায়  বর্ণিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, নির্মমতা , বাস্তবতা, ধ্বংসলীলা, কঠোর কঠিন জীবনে হারানোর  হাহাকার, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির আনন্দ বেদনা সবকিছুই। এ সময়ে কবিতায় নতুনত্ব আনলেন আব্দুল মান্নান সৈয়দ, জিনাত আরা রফিক, আবদুল্লাহ আবু সাইদ, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, দাউদ হায়দার, হুমায়ুন কবীর, শহীদ কাদরী, ময়ূখ চৌধুরী, মোহাম্মদ রফিক প্রমুখ ইতিহাস উত্তীর্ণ কবিগণ। প্রত্যেকেই  যেন নিজেদের ভেঙ্গে নতুন করে গড়লেন।

যে দাউদ হায়দার একদা লিখেছেন  – “সবাই চলে যায়, সবাই চলে যাবে একদিন / তবু কেউ কারো মুখ দেখবো না সঠিক / অস্পষ্ট ভালোবাসা বরং থেকে যাবে ইতস্ততঃ / আজীবন ইচ্ছেগুলো ভেসে যাবে বাতাসে নিলীমায়।“

সেই দাউদ হায়দার এর  কণ্ঠে আমরা শুনতে পাই- “কালো সূর্যের কালো জোছনায় কালো বন্যায়” যার কারণে তাকে নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে হয়েছে। সম্ভবত তিনিই বাংলাদেশের প্রথম নির্বাসিত কবি। তিনি লিখলেন- ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ। ‘

যে রফিক আজাদ ভালোবাসার সংজ্ঞা দেন- “ভালোবাসা মানে দু’জনের পাগলামি/  পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা।/  ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া / বিরহ-বালুতে খালি পায়ে হাহাহাটি… ‘  

সেই রফিক আজাদই  গন-মানুষের রোষ, হাহাকারকে সুতীব্র ভাষায় নিয়ে আসেন  কবিতায়- ‘ভাত দে হারামজাদা/ তা না হলে মানচিত্র খাবো।‘  

সময়কে ধারণ  করা এরকম কবিতাকে আধুনিক না বলে মূলত কোন উপায়ও  থাকে না।

আব্দুল মান্নান সৈয়দ এর ‘পরাবাস্তব  কবিতা’ গ্রন্থটি  আধুনিক কবিতার আরেকটি মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নিত করা যায় । তবে মজার ব্যাপার হলো কোন ধারাতেই  কবি বেশিদিন স্থির  থাকেননি  । না নিজে, না অন্যেরা যারা তাঁকে অনুসরণ করেছেন । ছন্দকে ভেঙ্গে, আঙ্গিকের পরিবর্তন করে নানারকম নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

আশির দশক জুড়েই চলেছে সেই ভাঙচুর। নব্বইয়ে সেই ভাঙ্গাগড়া চেতনারই  নবজাগরণ। অর্থাৎ তিরিশের আরোপিত আধুনিকতাকে নানা বিবর্তন ও বর্জনের মধ্য দিয়ে আবহমান বাংলাকে তুলে ধরার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন আমার উত্তর আধুনিক কবিরা।

মনে রাখা প্রয়োজন আধুনিক বা উত্তর আধুনিক শব্দগুলোকে আমরা  কবিতার  কাঁধে  চাপিয়ে তাকে যেন ভারাক্রান্ত না করি। কিশোরীর এলো চুলের সৌন্দর্যকে আধুনিক করতে গিয়ে যদি এমন পরিমাণেই ছেঁটে দেই যে বাতাস তাতে আর খেলা করার সুযোগ না পায় তাকে কতটা আধুনিকতা বলা যায়? সাথে সাথে এও প্রশ্ন আসবে তবে কি এলোচুল ইচ্ছেমতন বাড়তে দিয়ে পথের ধুলো কুড়াতে দেবো? না তাও নয়। তাকে যত্নে, পরিচর্যায় পরিমিত  মাত্রায় আনার বোধ যার  থাকবে  তিনিই হয়ে উঠবেন আধুনিক কবি।

পাহাড় কেটে মেকি সৌন্দর্য  বাড়াতে গিয়ে যদি পাহাড়ই খুঁজে পাওয়া না যায় তাতে যেমন হতাশ হতে হয় , তেমনি উপমা বা রূপকের  বাহুল্যে কবিতাই  যদি খুঁজে পাওয়া না যায় তবে কবিতার স্বাদ তো আলুনী লাগতেই পারে । অস্পষ্টতা আর  ঘনঘোর  রহস্যময়তায় কবিতাই হারিয়ে যায় তবে আধুনিকতাই থাকবে হয়তো, কবিতা থাকবে না। আমাদের ভুললে চলবে না যে কবিতা কোন প্রশিক্ষণ যোগ্য পেশা নয়। জটিল শব্দের আশ্রয় যদি কবিতার পাঠক থেকে কবিতাকে আলাদা করে ফেলে তবে  সেই আধুনিক জটিল আর দুর্বোধ্য  শব্দমালায় বড় বড় প্রবন্ধ তৈরি হতে পারে কিন্তু  কবিতা নয়।

শেষ করতে চাই  রবার্ট ফ্রস্টের একটি উক্তি দিয়ে -  

“আধুনিক মানুষকে যিনি তাঁর কথা শোনাতে পারেন তিনিই হলেন আধুনিক কবি। কবে তিনি  বেঁচে  ছিলেন সেটি বড় বিষয় নয়। তবে যদি আধুনিক কালে বেঁচে থেকেই কাজ করে থাকেন তাহলে তিনি আরো বেশি আধুনিক।“


No comments