DEHLIJ

নলিনাক্ষ ভট্টাচার্য

দেবুনামা






বল্লিমরানের গলি কাসিম জান-এ ঢুকে মির্জা গালিবের হাভেলির সামনে দাঁড়িয়ে দেবুদা আমাকে গালিবের একটি বিখ্যাত শের শুনিয়েছিলেন –

হাজারো খোয়াইশে এ্যায়সি কি হর খোয়াইশ পে দম নিকলে

বহোত নিকলে মেরে আরমান লেকিন ফির ভি কম নিকলে।

“ বেচারা গালিব এত কষ্ট করে নিজের পেনশন বাড়াবার জন্য কলকাতা ছুটে গিয়েছিলেন, কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ওঁর দরখাস্ত নামঞ্জুর করে দিয়েছিলেন,” দেবুদা বলেছিলেন আমাকে। 

আমার জীবনে দেবুদাই একমাত্র লোক ছিলেন যিনি রবীন্দ্রনাথ, গালিব এবং শেক্সপিয়ার থেকে আবৃত্তি করতে পারতেন। শুধু আবৃত্তিই নয়, বাংলা, ইংরেজি, উর্দু এবং হিন্দি এ চারটে ভাষাই দেবুদা যে খুব ভাল জানতেন তার প্রমাণ পেয়েছি বহুবার ওনার কথায় এবং লেখায়। দুঃখের বিষয় লেখার থেকে কথা বলায় উনি বেশি আনন্দ পেতেন তাই বাংলা লিটল ম্যাগাজিনে কয়েকটি লেখা আর সৈনিক সমাচারে কয়েকটি হিন্দি কবিতা ছাড়া ছাপার অক্ষরে কিছুই রেখে যেতে পারেননি উনি। ‘দিল্লি দূর নীস্ত’( দিল্লি দূরে নয়) নামে যে উর্দু উপন্যাস উনি শুরু করেছিলেন তা কোনদিনই সমাপ্ত হয়নি। ইংরেজিতে ‘ The Life and Times of Haridas Pal’ নামে যে আত্মজীবনী শুরু করেছিলেন দেবুদা তার প্রথম অধ্যায়টি আমাকে এক সন্ধ্যায় পড়ে শুনিয়েছিলেন। অনবদ্য ইংরেজিতে লেখা তাঁর ওই অসমাপ্ত উপন্যাসের প্রথম অধ্যায় থেকেই জেনেছিলাম( নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে যে অনীহা ছিল ওঁর সেটা প্রথম আলাপেই টের পেয়ে দেবুদাকে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার সাহস হয়নি কোনদিন) ওঁর বাবা মুর্শিদাবাদ থেকে ভাগ্যানেষণে দিল্লি এসেছিলেন গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে। একটা প্রাইভেট ইনসিওরেন্স কোম্পানির উঁচু পদে ছিলেন উনি, কাজেই দেবব্রত চক্রবর্তীর প্রথম জীবনটা খুব সুখেই কেটেছিল। ভাল ইংরেজি স্কুলে পড়া, ভাল খাবার-দাবার, ভালো পোষাক-আষাক, কিছুরই কমতি ছিলানা। নতুন দিল্লি তখন সবে তৈরি হয়েছে, কাজেই কনট প্লেসে ঘুরতে যাওয়া কিংবা দেশের বিভিন্ন স্বাধীন রাজ্যগুলোর রাজা-মহারাজারা যখন তাঁদের বিশাল ইম্পালা গাড়ি করে পার্লামেন্টে প্রিভি কাউন্সিলের মিটিং-এ আসতেন দেবুদার বাবা সে দৃশ্যও ছেলেকে দেখিয়েছিলেন। এসবই আমি জানতে পেরেছি ওঁর সেই অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে।

তারপর একদিন প্রাইভেট ইনসিওরেন্স কোম্পানিটা উঠে গেল আর দেবুদার বাবার কপালে তেমন ভাল কোন চাকরি জুটলনা। ফলে দেবুদাকে কিশোর বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হল। মা বাবা ছাড়াও ওঁর পরিবারে তখন দুই ছোট বোন। তাই ম্যাট্রিক পাশ করেই দেবুদাকে চাকরি নিতে হল ডিফেন্স এ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে যেখানে একসময় স্বনামধন্য লেখক নীরদ চৌধুরিও চাকরি নিয়েছিলেন।

দেবুদা স্বশিক্ষিত মানুষ ছিলেন। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যা শিখতে পারেননি তা উনি শিখেছিলেন লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে। ব্রিটিশ কাউন্সিল আর সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট থেকে গাদা গাদা বই আনতেন উনি যার মধ্যে ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি আর সমাজবিদ্যার বই প্রাধাণ্য পেত। কিন্তু ভাল উপন্যাস বা নাটকের বই পেলেও লাইব্রেরি থেকে তুলে নিতেন উনি। ভালো সিনেমা কিংবা নাটক তা যে ভাষাতেই হোকনা কেন দেবুদা ছাড়তেননা। এভাবেই লন্ডন থেকে রয়াল শেক্সপীয়ার কোম্পানি নাটক করতে এলে রফি মার্গে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে টিকিটের জন্য যে দীর্ঘ লাইন পড়ত তাতে দেবুদাকে প্রথম দশ জনের মধ্যেই দেখতে পেতাম আমি। ফিল্ম ফেস্টিভালে ভালো ছবি কিংবা কলকাতা থেকে আসা ভালো দলের নাটক দেখতে অনেকবারই ওঁর সঙ্গী হয়েছি আমি।    

দেবুদার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়েছিল এস্টেট অফিসে। আমি তখন ওই অফিসে চাকরি করি। উত্তর দিল্লির টিমারপুরে কিছু পুরনো সরকারি কোয়ার্টার ছিল, তার একটি ওঁকে এ্যালট করেছিলাম আমি। কেউ ওই কোয়ার্টারগুলোয় থাকতে চাইতেননা তাই ওখানে কোয়ার্টার পেলে চেঞ্জ নিয়ে দক্ষিণ দিল্লির কোয়ার্টারে চলে আসতেন সবাই কারণ সরকারি অফিসগুলোতো সব লুইটেনস দিল্লিতে বা দক্ষিণ দিল্লিতে। কিন্তু দেবুবাবু বললেন দক্ষিণ দিল্লি ওঁর তেমন ভালো লাগেনা, কাজেই উত্তর দিল্লিতেই ঘর নেবেন উনি। কথা বলে যখন বুঝতে পারলাম এই মানুষটি খুবই অন্য ধরণের তখন ওঁকে নির্মাণ ভবনের কফি হাউসে নিয়ে কফি খাওয়ালাম। জানতে পারলাম আজমীরি গেটের কাছেই সীতারাম বাজারে ভাড়া বাড়িতে থাকেন উনি। বিয়ে থা করেননি, কাজেই নিজে রেঁধে খান। আমাকে খাওয়ার  নিমন্ত্রণ করলেন পরের রোববার দুপুরে।

রোববার খেতে গিয়ে দেখি এলাহি কারবার। দু’দিন আগেই ছিল বক্‌রিদ। তখন বক্‌রিদে পাকিস্তান থেকে দুম্‌বা খাসি আসত যা বিক্রি হত জামা মাসজিদের লাগোয়া বাজারে। সেই দুম্‌বার মাংস ওর চর্বিতেই রান্না করে আমাকে খাইয়েছিলেন দেবুদা। সেরকম সুস্বাদু, নরম মাংস জীবনে কখনো খাইনি আমি আর ভবিষ্যতে খাবার আশাও রাখিনা, কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাওয়ায় বক্‌রিদে পাকিস্তান থেকে দুম্‌বা খাসি আর এদেশে আসেনা এখন।আর শুধু মাংস নয়, সে রোববার শুক্তো থেকে পায়েস, অন্তত এক ডজন পদ রান্না করেছিলেন দেবুদা আমাকে খাওয়াবার জন্য। সীতারাম বাজারের সেই বাড়িতে এরপর যখনই গিয়েছি দেবুবাবুর হাতের বাঙালি এবং মোগলাই দু’রকমের রান্না খাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার এবং দেবুবাবুর আরও কয়েকজন ঘণিষ্ঠ বন্ধুর। ওই বাড়িতেই বাবামা এবং দুই বোনের সঙ্গে একসময় থাকতেন দেবুদা। একে একে বাবামা চলে গেলেন, ছোট বোনটিও অকালে মারা গেলেন, শুধু দেবুবাবু রয়ে গেলেন। বিয়েথা কেন করলেননা কোনদিন জিজ্ঞেস করিনি ওঁকে কারণ সংসার করার মানসিকতা ছিলনা ওঁর। আমার মনে হয় কৈশোর বয়স থেকেই সংসারের ঘানি টানতে টানতে সংসারের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছিল দেবুদার মনে। আর একারণেই সম্ভবত কোন আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেননা উনি। একদু’বার আমাকে জানিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদ থেকে এক মামা দিল্লি কোন কাজে এসে দেখা করে গেছেন ওঁর সঙ্গে। মামার সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক যে খুব মধুর নয় সেটাও জানিয়েছিলেন আমাকে। 

পুরনো দিল্লির সঙ্গে আমার যেটুকু পরিচয় ঘটেছিল সত্তর এবং আশির দশকে তা দেবুদার সৌজন্যে। শুধু গালিবের হাভেলিই নয়, উনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তুর্কমান গেটের কাছে বুলবুলি খানায় রাজিয়া সুলতানের কবর দেখাতে। বেগম সমরুর ১৮০৬ সালে নির্মিত হাভেলিই যে এখন ভগীরথ প্লেস কিংবা উর্দু ভাষার উৎপত্তি যে পুরনো দিল্লির উর্দুবাজার থেকেই তা ওঁর কাছেই প্রথম শুনি। লাল কুঁয়া বাজারে জিনত মহলের হাভেলি আর সীতারাম বাজারে হাস্কর হাভেলি উনিই আমাকে দেখিয়েছিলেন। ওই হাস্কর হাভেলিতেই জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর মা কমলার বিয়ে হয়েছিল। পুরনো দিল্লির গলি ঘুঁজিতে কোথায় কী খাবার পাওয়া যায় তাও আমাকে চাখিয়ে দিয়েছিলেন দেবুদা। কোন এক রোববার দুপুরে জামা মসজিদের পাশের এক গলিতে নিয়ে সস্তায় বিরিয়ানি খাইয়ে, আরেক গলিতে শিক কাবাব এবং তৃতীয় এক গলিতে ফির্নি খাইয়ে এক সরু উঁচু নিচু গলি দিয়ে বাড়িতে ফিরে আসার সময় দেবুদা আমাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন উটের পিঠের মত হঠাৎ উঁচু হয়ে যাওয়া ওই গলির একটি অংশই দিল্লির সবচাইতে উঁচু রাস্তা। চৌরিবাজার হয়ে জামা মসজিদের দিকে এগোতে এগোতে একবার দেবুবাবু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ দিল্লির নিজস্ব মিস্টি কী বলতে পারবে?”

আমি বলেছিলাম , “ কেন, দিল্লিকা লাড্ডু?”

উনি বললেন, “ ওটা ঠাট্টার কথা। দিল্লির নিজস্ব মিস্টি হচ্ছে হাব্‌সি হালুয়া যা দক্ষিণ দিল্লির কোন দোকানে পাবেনা তুমি।“ জামা মসজিদের কাছেই একটি বিশেষ দোকান থেকে কালো রঙের বরফি জাতীয় যে মিস্টির দুটো পিস কিনলেন উনি তার দাম তখনকার দিনে, আশির দশকের প্রথম দিকেও বেশ উপরের দিকেই – একশো বিশ টাকা কিলো। ঘিয়ে তৈরি সেই মিস্টি সত্যিই খুব ভালো লেগেছিল আমার। চালের গুড়োর সঙ্গে খোয়া আর বাদাম পিস্তা দিয়ে তৈরি ওরকম মিস্টি পরে আর কখনও খাইনি। 

একাকী মানুষ শুধু বইপুঁথি নিয়ে থাকতে পারেননা, তাই দেবু বাবুও ছুটির দিনে আমাদের মত দু’একজন বন্ধু জুটিয়ে রাম-এর বোতল খুলে বোসতেন। আর ওই সময়-ই নিজের অজান্তে কখনো কখনো মনের দুঃখ কষ্ট আমাদের বলতেন। অল্প বয়সে মাবাবা হারিয়ে পড়াশুনা ছেড়ে ওঁকে যে রুজি রোজগারের জন্য চাকরিতে যোগ দিতে হল সেটা সারাজীবন ওঁকে হন্ট করত। আত্মীয়-স্বজনরাও যে বিপদের দিনে ওঁকে বিশেষ সাহায্য করেননি সেটাও বলতেন কখনো কখনো। ধর্মে যে বিশ্বাস করতেননা দেবুবাবু সেটা যৌবনে বামপন্থী রাজনীতির সংস্পর্শে এসেই হয়ে থাকবে। চাকরি পছন্দ করতেননা বলেই চাকরি শেষ হবার কয়েক বছর আগেই রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিয়েছিলেন দেবুদা। একটা ফ্রিজ, একটি ট্রাঞ্জিস্টার আর একটা টেপ রেকর্ডার কিনে ঘরে বসে গেলেন দেবুবাবু।  টেপ রেকর্ডারে রবীন্দ্রনাথ এবং শেক্সপিয়ার থেকে আবৃত্তি ধরে রেখেছিলেন, আমি আবৃত্তি করেছিলাম জীবনানন্দ দাসের একটি কবিতা। আমরা ছুটির দিনে গেলে না খাইয়ে ছাড়তেননা। বিশেষ পদ্ধতিতে মাংস রান্না করে দেবুদা আমাদের খাওয়াতেন আর আলোচনা করতেন সমসাময়িক রাজনীতি, সাহিত্য বা অর্থনীতি নিয়ে।

দেবুবাবু সংসার করার ঘোর বিপক্ষে ছিলেন, কাজেই বিয়ের পর একসময় আমাদের কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে ওঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। শুধুমাত্র একজন মাঝবয়সি ব্যাচেলার যিনি ওঁর ছোটবেলার বন্ধু ছিলেন সেই দেবনগরের বেণীদার সঙ্গেই ছিল দেবুদার আজীবন সম্পর্ক। কালেভদ্রে আমাদের মধ্যে কেউ দরিয়াগঞ্জ বা চাঁদনি চকে গেলে ওঁর সঙ্গে দেখা করে আসত আর তার মাধ্যমেই আমরা ওঁর খবর পেতাম। এরকমভাবেই একদিন আমরা জানতে পারলাম দেবুদা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কখনো কখনো কোন বিষণ্ণ সন্ধ্যায় আজও মনে পরে যায় দেবুবাবুর সঙ্গে প্রথম সেই মদ্যপানের স্মৃতি।  জিজ্ঞেস করেছিলাম দেবুদাকে আমরা কেউ ডাকলে উনি আমাদের মদ্যপানের আসরে আসবেন কিনা। আমার গ্লাসে গ্লাস ঠুকে গালিবের শের শুনিয়েছিলেন দেবুদা – 

মেহেরবান হোকে বুলালো মুঝে চাহো জিস বক্ত

ম্যয় গয়া বক্ত নাহি হুঁ কি ফির আ ভি না সঁকু।

অনেক সময় মনে হয় ওঁর মত একজন বিদগ্ধ, রসিক মানুষ আজ পাশে থাকলে শেষ জীবনটা আনন্দে কাটাতে পারতাম আমি। 


No comments