DEHLIJ

ফরিদ ছিফাতুল্লাহ


নতুন কবিতা ভাবনা~চিহ্নকবিতা প্রসঙ্গ 


 


চিত্ত চর্চার শুরু কবে থেকে? প্রাচীন গুহাগাত্রে অঙ্কিত পশুর ছবি দেখে অনুমান করা যায় মানুষের চিত্ত চর্চার সূচনা ভাষা আবিষ্কারেরও পূর্ববর্তী। এরপর ভাষা । আর ভাষা আবিষ্কারের অব্যবহিত পরেই মানুষ ছন্দোবদ্ধ বাক্যের সৃষ্টি করেছিলো। পৃথিবীর প্রথম কবিতাটি তাই মুখে মুখে রচিত। কারণ তখন পর্যন্ত লিখন পদ্ধতি আবিষ্কৃতই হয়নি।  

ব্যাবিলনীয় 'গিলগামেশ', মিশরীয় প্রাচীন কাব্যগাথা, গ্রীক ও ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনীসমুহ মূলত মুখে মুখে রচিত এবং স্মৃতিবাহিত। প্রাচীনকালে ইতিহাস,ধর্মকথা,যুদ্ধ বিগ্রহ,আইন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা কাব্যভাষায় রচিত, গীত ও অধীত হতো। ছন্দোবদ্ধ বাক্যাবলী মুখস্থ করা সহজ বলেই হয়তো মানুষ আজ প্রাচীন জ্ঞান ভাণ্ডারের এক বিপুল উত্তরাধিকার অর্জন করেছে সেইসূত্রে । আজকের সভ্যতায় বাসকারী মানুষেরা বংশগতিগত কারণেই হোক কিংবা চিরায়ত মানব প্রকৃতির কারণেই হোক অতীতের তুলনায় অধিকতর কবিতানুবর্তী। কবিতা আজ এক মহোত্তম শিল্প মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত। নতুন নতুন কবিতা যেমন লেখা হচ্ছে, তেমনি কবিদের মাঝে নতুন কবিতাভাবনারও উন্মেষ লক্ষ করা যাচ্ছে। কবিতার চেহারাবয়ব, ভাষা,বিষয়, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এমনকি কবিতার উদ্দেশ্য লক্ষ্য বা উপযোগিতা নিয়েও নতুন নতুন চিন্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে। ঐকমত্যের বা মতানৈক্যের, পরস্পর সাংঘর্ষিক বা মিলনাত্মক , সকল চিন্তাধারাই শেষ পর্যন্ত কবিতাকেই পুষ্ট করে চলেছে।

শুরুতে ছন্দোবদ্ধ কথামালা কবিতা বিবেচিত হলেও বর্তমানে অদৃশ্য ভাবছন্দ এবং গভীর অর্থপ্রদ তাৎপর্যময় শ্রুতিব্যঞ্জনাও কবিতা বলে স্বীকৃত। আর অতি বর্তমানে এই ধারণার বাইরেও কবিতা তার জগত বিস্তার করছে বলে লক্ষ করা যাচ্ছে। কবিতার এই নতুন বিস্তার নিয়েই কিছু চিন্তার অবতারণা করতে চাই। এই চিন্তা দুশ্চিন্তা বা আশাবাদ দ্বিবিধই হতে পারে। কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকা বা সম্ভাবনা দুইই হতে পারে।

কবিতার সার্বজনীন কোন সংঙগা নেই। অন্তত এমন কোন সংঙগা পাওয়া যাবে না যেটি সকলের কাছে পূর্ণাঙ্গ সংঙগা হিসেবে স্বীকৃত হতে পারে। কবিতা বিষয়ক আলোচনা এবং কবিতাচর্চার ক্ষেত্রে এ এক বিরাট সমস্যা। সুস্পষ্ট সংঙগা থাকার অর্থ হলো আপনার বাড়ির চারপাশ দিয়ে শক্ত প্রাকার ও সীমানা চিহ্নিতকরণ। এটি থাকলে আপনার বাড়ির সীমানায় অন্যের অনুপ্রবেশ সহজেই শনাক্ত করা যাবে। প্রয়োজনে অনুপ্রবেশ ঠেকিয়ে দেওয়াও যাবে। অন্যথায় অনির্ণীত সীমারেখাসম্পন্ন ভিটেবাড়িতে আপনার প্রকৃতিবিরুদ্ধ যে কারো, যে কিছুরই প্রবেশ বা উৎপাদন সম্পন্ন হতে পারে। সেক্ষেত্রে এক ধরণের নৈরাজ্য সৃষ্টি হতেই পারে।

এর চেয়েও বেশি দুশ্চিন্তার বিষয় হলো কবিতাকর্মীরা এই সমস্যাটির সমাধান বিষয়ক আলোচনায় উপযুক্ত মেধা ও শ্রম লগ্নি করছেন না। এমনকি কবিতার এই সার্বজনীন সংঙগা না থাকাটা যে একটা বড় সমস্যা সেই কথাটাও কাউকে ভাবতে দেখা যায় না। একাডেমিকভাবেও কাউকে এই সমস্যা নিয়ে তেমন একটা ভাবতে দেখা যায় না। বাজারে প্রচলিত কবিতার সংঙগাগুলি অধিকাংশই উচ্ছ্বাস বা হেয়ালিপূর্ণ, খণ্ডিত বা অপূর্ণাঙ্গ। কবিতার মতই কবিতার অধিকাংশ সংঙগাও ইঙ্গিতপূর্ণ, প্রতীকী, রহস্যময়, দ্ব্যর্থবোধক এবং ব্যাখ্যাসাপেক্ষিক।

সংঙগার এই স্পষ্টিকরণ সাধিত না হলে আমাদের পক্ষে কোন রচনাকে কবিতা বা অকবিতা বলে সিদ্ধান্ত প্রদান করা চিরকালই অমীমাংসিত থেকে যাবে। একই সাথে কবিতার ভিটেমাটিতে অন্যবিধ শিল্পকর্মের অনুপ্রবেশ চলতেই থাকবে। বোধ করি আগাছাও জন্মাতে থাকবে।

সংঙগার সমস্যা থাকা সত্বেও কবিতা সম্পর্কে আমাদের মনে কিছু সাধারণ ধারণার অস্তিত্ব আছে। যেমন আমরা মনে করি "কবিতা সাহিত্যের সেই অনন্য মাধ্যম যা ভাষার নান্দনিক ছন্দোবদ্ধতার গুণসম্পন্ন এবং যা পাঠে গভীর তাৎপর্য ও অর্থ বা বোধের উৎপত্তি ঘটে।" বুদ্ধদেব বসু কবিতাকে বোঝার নয় অনুভবের বিষয় বলে বর্ণনা করেছেন। যদিও 'বোঝা' ও 'অনুভব' এর পার্থক্য কী তা এক বিরাট প্রশ্ন। কেননা কোন কিছু না বুঝে কীভাবে অনুভব করা যেতে পারে সে এক রহস্যই বটে। 'উপলব্ধি' ছাড়া আসলে তো 'অনুভব' অসম্ভব। জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রভুত উন্নতি সত্বেও মানুষ অবশ্য কিছু অনুভূতি এখনো ভাষায় ব্যক্ত করতে পারে না। সে সকল ক্ষেত্রে আমাদের আশ্রয় কেবল 'অনুভবে'। বুদ্ধদেব বসুর চেয়ে আমার কাছে বরং রবার্ট ফ্রস্টের কথাটাই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হয়। অনুবাদে যা হারিয়ে যায় তাই কবিতা। কবিতা বোঝা যাচ্ছে না? বোঝা ভাষায় তা অনুবাদ করে অর্থোদ্ধার করে নাও। তারপর সেই উদ্ধারকৃত অর্থ ফেলে দাও। বাকি যা থাকলো তাই কবিতা। মানে হলো বোঝাবুঝি বা অবহিতিটুকুও কবিতায় থাকা জরুরী। কবিতার প্রকৃতি প্রসঙ্গে ফরাসী কবি পল ভ্যালেরি খুব চমৎকার করে বলেছেন- হেঁটে যাওয়ার নাম গদ্য আর নৃত্যের নাম কবিতা।

কবিতার প্রকৃতি প্রসঙ্গে আমরা আরো যা ভেবে থাকি-

"কবিতার উদ্দেশ্য জ্ঞান বৃদ্ধি করা নয় যদিও কবিরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানদাতা। কবিতা সুর নির্ভর নয় কিন্তু শ্রেষ্ঠতম সুরগুলি কবিতাকে আশ্রয় করেই জন্মলাভ করে। কবিতা চিত্রকলা নয় কিন্তু অসাধারণ সব চিত্রকল্প কবিতাতেই নির্মিত হয়। কবিতা উপন্যাস নয় কিন্তু কবিতায় উপন্যাসের চেয়েও অনেক বেশি চরিত্র সৃষ্টি সম্ভব। কবিতার প্রতিটি শব্দই আসলে একেকটি চরিত্র। কবিতা নাটক নয় অথচ প্রতিটি কবিতাতেই নাটকীয়তা থাকতে দেখা যায়।"

প্রাত্যহিক সাধারণ কথামালা আর কবিতার মধ্যে পার্থক্য নিয়ে ভাবতে থাকলে অনেক সময় নদীর জলের কথা মনে হতে পারে। নদীর দুপাড় ঘেষে থাকে ঘোলা পানি। মাঝ নদীতে স্বচ্ছ টলটলে জল। নদীর ঠিক কোন স্থানে এই পরিবর্তনটি সূচিত হয়েছে তা নির্ণয় করা কঠিন। সাধারণ দিন যাপনে আমাদের মুখ নিঃসৃত কথামালা ধীর লয়ে বিশেষ ধরণের ভারী কণ্ঠে উচ্চারণ করলেও এক ধরণের কবিতা কবিতা ভাবের উৎপত্তি ঘটে। এই যে আমরা পঙক্তির পর পঙতি সাজানো দেখে স্বাভাবিক প্রাত্যহিক কণ্ঠ থেকে ভিন্ন এক কণ্ঠে কবিতা পাঠ করতে থাকি -এই রীতির জন্ম কবে? এটির জন্ম আসলে কবিতার জন্মের সময়কালীন। আদিম কৃষিভিত্তিক সমাজে ভালো ফলনের আশায় মানুষ যে মন্ত্র উচ্চারণ করতো সেগুলোকেই ধরা যেতে পারে পৃথিবীর প্রথম কবিতা হিসেবে। তখন সেই মন্ত্রগুলো উচ্চারণ করা হতো অনেকটা দৈব কণ্ঠের মতো করে। ("speaketh somewhat above a mortal mouth.”- Ben Johnson) আমাদের আজকের বাচিক শিল্প সেই প্রাচীন মন্ত্রোচ্চারণের ঐতিহ্য আজো ধরে রেখেছে। তাই সাধারণ কথামালাও উচ্চারণ বা পাঠের এই ঐতিহ্যবাহী রীতির কারণে কবিতা হয়ে উঠতে পারে। অন্তত কবিতার মতো শোনাতে পারে। আর তাই 'অকবিতা' বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব জগতে থাকতে পারে না বলেই ধারণা করি। আমাদের বরং কোন রচনা প্রসঙ্গে 'কবিতা', 'অল্পকবিতা', 'কম কবিতা' ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করাই অধিক যুক্তিযুক্ত।

আজকের কবিতা উন্মেষ কালের কবিতার চেয়ে অনেক বেশি প্রতীকাশ্রয়ী, অনেক বেশি রহস্যময়, অনেক বেশি অর্থব্যঞ্জনাময়। কিন্তু কেন? এর উত্তর বোধ করি নিহিত আছে চিরন্তন মানব প্রকৃতির ভেতর, জৈব-মানুষের সংগ্রামমুখর ইতিহাসের ভেতর- যেখানে গতিশীলতা মানবজীবনের ধর্ম। যেখানে মানুষ শ্রম দ্বারাই অর্জন করে সকল সুখ ও সাফল্য। বিনাশ্রমে প্রাপ্ত কোন কিছুই মানুষকে সুখী করে না, আনন্দ প্রদান করে না। শ্রমমুখী মানুষ তাই শিল্পের আনন্দ বিনাশ্রমে পেতে চায় না। চিন্তনপ্রক্রিয়া সচল করে মানুষ শিল্পের গভীরতার অনুসন্ধান করতে চায়। সেখানেই মাহাত্ম্য নিহিত রয়েছে বলে মানুষের বিশ্বাস। যে কথা সরাসরি বলা যায় সে কথাও মানুষ তাই ইশারায় বা উপমায় বলতে চায় বা শুনতে চায় । এহেতু রহস্য সৃষ্টি ও ভেদ মানুষের পছন্দের। অধিকন্তু বুদ্ধিবৃত্তি মানুষের এই প্রবণতায় ত্বরণ সৃষ্টি করে। বুদ্ধির বিনিয়োগে অর্থোদ্ধার মানুষের এক পরম শ্লাঘা। বৈরী প্রকৃতিতে টিকে থাকতে সেই যে মানুষ প্রকৃতির নানান রহস্য আবিষ্কারে মেতে উঠেছিলো, সেই আবিষ্কারের নেশা মানুষ আর ছাড়েনি, বরং দিনে দিনে তা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করতে করতেই মানুষ শিখে গেছে এই আড়াল আর আড়াল উন্মোচনের খেলা। শুধু কবিতা কেন চিত্রকলা, নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাস শিল্প সাহিত্যের সকল শাখায় এখন তাই জাদুবাস্তবতা, পরাবাস্তবতা,অধিবাস্তবতার চর্চা।

কবিতা নিয়ে মানুষের ভাবনা নানান ভাবে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। বিশ শতকীয় একদল কবির আবির্ভাব লক্ষ করা গেল যারা বলছে কবিতায় কোন উপমা নয়, কোন দৃশ্যকল্প নয়। ছিড়ে ফেলো সেসব। কবিতাকে করে তোলো বিপ্রতীক। কবিতার ইতিহাসে এটি অভিনব চিন্তা নিঃসন্দেহে। কিন্তু কবিতায় দৃশ্য নির্মাণ ঠেকানো কীভাবে সম্ভব? প্রত্যেক ভাষার প্রতিটি শব্দই দৃশ্য নির্মাণের একক। একেকটি ইট। এই ইটগুলি যেভাবেই ব্যবহার করা হোক না কেন তা প্রবেশ্য বা অপ্রবেশ্য কোন না কোন কাঠামো নির্মাণ করবেই। খুব সচেতন প্রচেষ্টাতেও এই প্রক্রিয়া রুদ্ধ করা অসম্ভব। দ্বিতীয় কথা হলো দৃশ্য ছাড়া আর কী নির্মাণ করতে হয় কবিতায়? এর মাধ্যমে কবিতাকে কি তাঁরা অতীন্দ্রীয় কোন কিছুতে রূপান্তর করতে চাইছেন? সে ক্ষেত্রে কবিতা হয়ে যাবে স্পর্শ বা দর্শন বহির্ভূত ইন্দ্রিয়াতীত কোন বিষয়। এই নতুন ধরণের কবিতাভাবনার বিষয়ে সমকালে কিছুই বলা যায় না শুধু পর্যবেক্ষণ করে যাওয়া ছাড়া । অনাগতকাল এর যথার্থ বিচার করবে। হয়তো কবিতাভাবনা হিসেবে এটি সুপুষ্ট ধারায় প্রবাহিত হতে থাকবে, না হয় স্তিমিত হয়ে যাবে ধীরে ধীরে। যেটিই ঘটুক না কেন কবিতার ইতিহাসের একটি অংশ হয়েই থাকবে এই নতুন কাব্যচিন্তা।

 

নতুন ধরণের কবিতা লিখতে ইমেজ, অর্থ, দৃশ্য,প্রতীককে বিদেয় করে দেওয়ার ভাবনাকে অনুসরণ করেই বোধ করি কেউ কেউ কবিতার রক্ত মাংসের শরীরে নিয়ে আসছেন লোহা, পাথর ইত্যাদি। কবিতার কোমল শরীরে ঠুকে দিচ্ছেন ধাতব পেরেক।এটিকে কতটুকু কবিতাপ্র‍য়াস বলা যাবে তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছুকাল। কারণ সবকিছুর ঊর্ধ্বে সময় হলো আসল বিচারক।

একটি কবিতা উদ্ধৃত করছি এখানে—




এটি কবি রাহুল গাঙ্গুলির একটি কবিতা কবিতাটি অনলাইন জল্প ই পত্রিকায় প্রকাশিত। কবিতার আবহমান যে শরীর আমাদের চেনা তা থেকে পুরোপুরি ভিন্ন এক চেহারার এই সৃজন। গ্যালিলিও গ্যালিলি বহু আগেই বলে গেছেন প্রকৃতি গণিতের ভাষায় কথা বলে। প্রকৃতির সেই গাণিতিক ভাষায় লেখা (নাকি অঙকিত?) এই শিল্পকর্মটি। অবশ্য লেখালেখিও এক ধরণের অংকন বলে ভাবেন কবি রাহুল গাঙ্গুলি। তিনি প্রায়শই বলে থাকেন কাগজে বর্ণ লিখতে ( বা আঁকতে) আমাদের প্রথমে বিন্দু আঁকা দিয়েই শুরু করতে হয়। তাই বর্ণও আসলে প্রতীক। এটি অবশ্য নতুন কথা নয়। বৈয়াকরণিকগণ সব সময়ই বলে আসছেন বর্ণ ধ্বনির প্রতীক। কিন্তু রাহুল গাঙ্গুলি বর্ণের এই প্রতীকতায় আরো একটি নতুন মাত্রা যোগ করতে চান। আর সেটি হলো প্রতীকের স্বাধীন ব্যবহারযোগ্যতা । ব্যাকরণের বর্ণ ধ্বনির প্রতীক মাত্র। এর বেশি কিছু নয়। সেখানে অর্থ নেই কোনো। রাহুল গাঙ্গুলি তাঁর কবিতায় এই আপাত অর্থহীন ধ্বনিচিহ্নগুলি ব্যবহার করছেন বিশেষ অর্থমাত্রা প্রযুক্ত করে । এবং এই প্রক্রিয়ার অগ্রবর্তী ধাপেই তিনি কবিতার শরীরে আমদানি করেছেন গাণিতিক চিহ্নাদি। বলছেন "যেখানে কম্পিউটার '০' এবং '১' ছাড়া কিছু বোঝে না, সেখানে আমরা যে কোনো কাজে/ যে কোনো ভাষায় কম্পিউটারের সাহায্য নেবো, প্রযুক্তিকে চাইবো~ আর শিল্পবোধে সেই প্রযুক্তির কথা বললেই বলবো,সাধারণ পাঠকের সময়ের অভাব।" তাহলে কি কবিতা বুঝবার জন্য মানুষকেও কম্পিউটারের মতো যন্ত্রে রূপান্তরিত হতে হবে? রাহুল গাঙ্গুলি আমার ধারণা প্রযুক্তি বিষয়টকেই এক গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়েছেন। প্রযুক্তি কখনোই মানুষের হৃদয়বৃত্তির জায়গা নিতে পারবে না। আর যদি নিয়েও নেয় তখন আসলে মানুষ প্রজাতির বিলুপ্তি সাধিত হবে। সেই নতুন প্রাযুক্তিক জগতে শিল্প (art) বলে কিছু থাকবে না, তবে শিল্প( industry) থাকতে পারে।

রাহুল গাঙ্গুলির আরেকটি কবিতা দেখা যাক- ( 'দেখা' অর্থেই)




এই কবিতা কীভাবে পঠিত হবে সেইরকম এক প্রশ্নের উত্তরে রাহুল গাঙ্গুলি বলেছেন পাঠক অভ্যস্ত হয়ে পড়বে একদিন। গাঙ্গুলি এই চিহ্ন কবিতার পক্ষে বলতে গিয়ে বিজ্ঞানকে টেনে এনেছেন। বলেছেন ন্যানোপ্রযুক্তির যুগের কথা। ব্যবহার করেছেন 'কবিতার মহাবিজ্ঞান' শব্দবন্ধ। জগদীশ চন্দ্র বসু কি 'প্রতিটা বস্তুর ভিতরেই প্রাণ আছে' প্রমাণ করেছিলেন? গাঙ্গুলি সেরকমই দাবী করেছেন। কণাদের বস্তুকণার পারমানবিক গঠন, রাশিচক্র, পিরামিড চিত্রলিপি ইত্যাকার সংকেতের প্রসঙ্গ টেনে এক বিরাট ভজঘট অবস্থা তৈরি করেছেন।

আমার সন্দেহ জাগে মানুষের জ্ঞানপ্রক্রিয়া সরলরৈখিক নাকি বৃত্তীয়। ক্রমেই আমরা জ্ঞানের উচ্চ শিখরে উত্তীর্ণ হচ্ছি নাকি জ্ঞান অর্জন করতে করতে বৃত্তীয় পথে ফিরে আসছি আগের পথে। প্রাচীন ভারতীয় সত্য,ত্রেতা,দ্বাপর,কলি চতুর্যগের অনিঃশেষ আবর্তনের মতো। “মুদ্রণের উন্নত অবস্থায় কবি সম্ভাব্য উপায়ে এবং প্রয়োজন অনুসারে কবিতার বিন্যাসে দৃষ্টিগ্রাহ্য ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে পারেন’ -গত শতকের ৬ এর দশকের মাঝামাঝি সৃষ্ট শ্রুতি সাহিত্য আন্দোলনের ইশতেহারের এই সনদ আজকের সময়ের কবিকে প্রেষিত করতেই পারে।মান্যতাও প্রদান করতে পারে। তবে এই সনদ শর্তসাপেক্ষিক।  “উপলব্ধির গভীরতাকে নব নব আত্মিক অভিজ্ঞতাকে ভাষায় যথার্থ প্রকাশ করতে না পারার অতৃপ্তি এবং সংশ্লিষ্টভাবেই ব্যবহৃত ভাষা পদ্ধতির জীর্ণতা সম্পর্কে অনুভব প্রত্যেক সচেতন কবির মনে সদাজাগ্রত” । আর তাই এই সময়ের কবি রাহুল গাঙ্গুলির হাত ধরে এই চিহ্নকবিতার আন্দোলন। তবে এটাও ঠিক শ্রুতিরাই বলে গেছেন-“কবিতার সার্থকতা বিচার করে পাঠকের মন” এবং তাঁরা শর্ত প্রযুক্ত করেছেন-“কবির দিক থেকে উপলব্ধির প্রকাশকে সঞ্চারণক্ষম করে তোলার ক্ষমতা ও নৈপুণ্য প্রয়োজন”।  বোধ করি শ্রুতিদের এতকাল পরে রাহুল গাঙ্গুলি ও তাঁর অনুসারীগণ এই ‘ক্ষমতা’ ও ‘নৈপুণ্য’ প্রদর্শন করতে সমর্থ হয়ে উঠছেন।   

 

কবিতা কী? কবিতা কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে আরিস্তোতলীয়, প্লাতো, লীলাবাদী বা কলাকৈবল্যবাদী, প্রকাশবাদীরা একেক উত্তর দেবেন। কিন্তু শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, দর্শন সবকিছুই বিচার্য হওয়া উচিত মানুষের প্রয়োজনের নিরিখে। শুধুমাত্র চিন্তার উদ্রেক করাই যদি কবিতার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে চিত্রকলা বা দর্শনের সাথে কোথায় এর ভেদ রেখা? চিন্তার উদ্রেক করা নিঃসন্দেহে কবিতার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য কিন্তু একমাত্র নয়। বরং এক শিল্পনান্দনিক উপায়ে মানব মনে এক অনুরণন সৃজন করে নতুন চিন্তায় মানুষকে এক আন্দন্দস্রোতে ভাসিয়ে দেওয়াও কবিতার উপযুক্ত লক্ষ্য। তাই কবিতা নান্দনিক শিল্প মাধ্যম। কবিতায় বিদ্যারস থাকতে বাধা নেই। কিন্তু বিদ্যারস নয় কাব্যরসই কবিতাকে অন্য শিল্প মাধ্যম থেকে পৃথক করে তোলে- এই কথা ভুলি কেমন করে?

রাহুল গাঙ্গুলির চিহ্নকবিতাকে যদি কবিতা বলে ধরে নিই তাহলে বলতে হবে কবিতা আর পাঠের বিষয় থাকছে না, দর্শন বা প্রদর্শনের বিষয় হয়ে উঠছে। আমি তো কবিতার চেয়ে একে চিত্রকলার নিকটবর্তী এক নতুন ধরণের শিল্প মাধ্যম হিসেবেই দেখতে পাচ্ছি।

 

শাব্দিক সাব্বিরের একটি কবিতা পড়ুন বা দেখুন অথবা দেখতে দেখতে পড়ুন বা পড়তে পড়তে দেখুন-

 



এই শিল্পকর্ম শিল্পবৃক্ষের কোন শাখায়, সাহিত্য নামের দালানের কোন প্রকোষ্ঠে জায়গা নেবে? পাঠক নাকি দর্শক এর শিল্পরস আস্বাদন করবে? 'কবিতা' পদবাচ্য হলে এর কাব্যরস নিহিত কোথায় কতটুকু? তবে নিঃসন্দেহে এই কবিতা চিন্তারসে বিপুলভাবে সিক্ত। এবং এই চিন্তারসে স্নাত হতে শিল্পানুরাগীর এক ধরণের প্রস্তুতি প্রয়োজন যে প্রস্তুতি সমকালে উপস্থিত কি না তা নিয়ে খানিক সন্দেহ আছে। অনাগতকালে পঠিত হবার আগ্রহই আজকের কবিকে এই নিরীক্ষা করতে প্রলুব্ধ করছে বলে যে কারো মনে হতে পারে। রাজনৈতিক ইতিহাসের মতো, প্রাকৃতিক বিবর্তনের মতো শিল্প-সাহিত্যেরও একটি স্বাভাবিক বিবর্তন আছে। এই বিবর্তন প্রক্রিয়াকে কৃত্রিম করে তুলবার প্রয়াস বা কোন উল্লম্ফন কবিতার যাত্রাকে বিপথগামী করতে পারে । শ্রুতিদের কথায়- ‘কবিতা বুদ্ধির চমক নয় ব্যাকুল সন্যাস”। তবে কবিতার বিবর্তনের ইতিহাস পাঠ করলে বুঝতে পারি, কবিতারও একটা বাঁক বদলের সময় সমুপস্থিত। 

একই সময়ে লেখা আরেকটি কবিতা পাঠকের সামনে হাজির করছি- 



এই কবিতাতেও প্রথাগত যতিচিহ্নের বাইরে চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু তা অত্যন্ত সীমিতভাবে, কাব্যরসসিক্ত করে বিপ্রতীকে। চিহ্নকবিতার দিকে কবিতার বিবর্তনের মাঝপথে এটি একটি মিসিং লিংক বলে মনে হয়। এই বিবর্তন প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়া যায়। এতে কাব্যরসের প্রাবল্য আছে। আছে চিন্তারসও। এটিই নিশ্চিতভাবে এই সময়ের কবিতা। তাই বলে কি ভবিষ্যতের পাঠতালিকায় এটি থাকবে না? এর উত্তর ভবিষ্যতের কাছেই জমা আছে। তবে যা সমকালের গুণসম্পন্ন নয় তা মহাকালেও স্থান পায় না। মহাকালতো হাজারো সমকালেরই এক নিরন্তর প্রবাহ।

মানুষের হৃদয়বৃত্তির প্রবণতাগুলো চিরকাল এক রকমের। প্রেম, দুঃখ, ভালোবাসা, সংকট, সম্ভাবনা, ক্ষমা, বিরহ, অহংকার, গৌরব, ক্ষোভ, আনন্দ, সুখ সবকিছুই চিরকাল এক রকম। মানুষ চিরকালই এইসব মৌল প্রবণতা নাটকে, সিনেমায়, গল্পে, কবিতায় অনুসন্ধান করবে। তাই কবিতায় জীবনের গভীরতম দর্শন চিন্তা যেমন থাকবে তেমনি সেই রসময় জীবনও থাকবে যে জীবনরসকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় দর্শনের সকল চিন্তা। হয়তো বিজ্ঞানের এই যুগে মানুষের মৌল প্রবণতাগুলোর মৃত্তিকাতে আসতে পারে নতুন নতুন পুষ্টি উপকরণ। নতুন নতুন প্রেষণা ও প্রেক্ষিত। এর ফলে শিল্পস্বাদেরও পরিবর্তন ঘটতে পারে। কে না জানে নিত্য-পরিবর্তনই এই জগতের অপরিবর্তনীয় নিয়ম।


No comments